সাড়ে তিন বছরের শিশু ওয়ালিদকে তাহলে খুন করল কে
শোবার ঘরে ছোট্ট ওয়ালিদকে শুইয়ে রেখে মা গিয়েছিলেন গোসল করতে। ফিরে এসে দেখেন, সাড়ে তিন বছরের শিশুটি ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে নিথর পড়ে আছে মেঝেতে। এ ঘটনার দুই বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। হত্যার বিচার তো দূরের কথা, পুলিশ এখনো জানতেই পারেনি, কেন এই হত্যা। ওয়ালিদের প্রবাসী বাবা মুহাম্মদ জাবেদ (৪০) দেড় মাস আগে দেশে এসেছিলেন ছেলেহত্যার বিচারের অগ্রগতি জানতে। অনেক ঘুরে অবশেষে হতাশা নিয়ে গত বুধবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মস্থলে ফিরে গেছেন তিনি।
২০২২ সালের ১৫ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর শিকারপুরে সাড়ে তিন বছরের শিশু মুহাম্মদ ওয়ালিদকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় তদন্ত অব্যাহত আছে। ওই গ্রামের ৩৫ থেকে ৪০ জনকে এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে দুই বছর পেরোলেও পুলিশ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারায় নিহত শিশুটির পরিবারের হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে।
ওয়ালিদের মা ইসরাত জাহান (৩০) সন্তানকে হারানোর পর থেকে বেশির ভাগ সময় পাশের উপজেলা রাউজানের উরকিরচরের সওদাগর পাড়ায় অবস্থিত তাঁর বাবার বাড়িতেই কাটান। কারণ, শ্বশুরবাড়িতে ছেলের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সবখানে। সেসব দেখে স্বাভাবিক থাকা অসম্ভব তাঁর পক্ষে।
১০ মাস আগে জাবেদ-ইসরাত দম্পতির কোল আলো করে এসেছে আরেকটি সন্তান। বুধবার বিকেলে হাটহাজারীর শিকারপুরে ওয়ালিদের বাবা জাবেদের বাড়িতে গিয়ে বসার ঘরেই পাওয়া গেল তাকে। নবজাতককে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন বাবা, পাশে মা ইসরাত জাহানও ছিলেন। জাবেদ একটু পর বিমানবন্দরের পথে ছুটবেন। রাতে বিমানে উঠবেন তিনি। তার আগে ছেলে আর স্ত্রীর সঙ্গে একটু সময় ভাগ করে নেওয়া। কথা শুরু করতেই মুঠোফোনে ওয়ালিদের ছবি দেখিয়ে জাবেদ ও ইসরাত বললেন, ‘দেখেন, আমাদের ওয়ালিদের মতো হুবহু আরেকটা ওয়ালিদ আমাদের দান করেছেন আল্লাহ। ওর ভেতরই এখন আমরা ওয়ালিদকে খুঁজে পাই।’
ওয়ালিদের বাবার ফ্লাইট ধরার তাড়া। তার মধ্যেই একফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, গত মে মাসে তিনি ছেলের হত্যাকাণ্ডের মামলার অগ্রগতি জানতে ও বিচারকাজ দেখার আশা নিয়ে দেশে আসেন। থানা, পুলিশ, আদালত ঘুরে কোনো ফল না পেয়ে আজ (গতকাল) তিনি আমিরাতের কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন আবার।
গত দেড় মাসে জাবেদ একাধিকবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছেন। সন্দেহজনক আসামির কথাও বলছেন, কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখছেন না। জাবেদ বলেন, ‘আমাদের বুকের ধন কেড়ে নেওয়ার বিচার চাই। খুনিদের চেহারা দেখতে চাই। ফাঁসির রশিতে ঝুলতে দেখতে চাই। নইলে এই জীবনে শান্তি পাব না।’
ওয়ালিদের মা ইসরাত জাহান কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘খুনি আমরা শনাক্ত করে পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু তারা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিচ্ছে। গ্রেপ্তার করছে না, জেলে পাঠাচ্ছে না। তাহলে কি আমার ছেলেকে কেউ খুন করেনি?’
দুই বছরেও খুনের ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মামলার বাদী নিহত ওয়ালিদের চাচা প্রকৌশলী মুহাম্মদ আজাদ। তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার পুলিশকে সন্দেহজনক আসামির নাম–পরিচয় জানিয়েছি কিন্তু তাঁদের ব্যাপারে কেন নীরব, সেটি বুঝতে পারছি না। আমরা চাই সন্দেহভাজন আসামিদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হোক।’
শিশু ওয়ালিদ খুন হওয়ার ২ দিন পর ২০২২ সালের ১৭ জুন রাতে মামলা করেন তার চাচা মুহাম্মদ আজাদ। ঘটনার দুই দিন পর বাড়ি থেকে একটি ছুরি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ছুরিটি শিশু ওয়ালিদকে খুনে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া দরজার হাতল ও ছিটকিনিতে লেগে থাকা রক্তও আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়।
খুনের ঘটনা শুরুতে পুলিশ তদন্ত করলেও হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন মাস পর মামলা হস্তান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।
জানতে চাইলে মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন আজ বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নানাভাবে এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করেছেন। ওই গ্রামের ৩৫ থেকে ৪০ জনকে পিবিআই কার্যালয়ে ডেকে এবং সরেজমিন ঘটনাস্থলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা আসামি শনাক্ত কিংবা কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।
ওয়ালিদের পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী সন্দেহভাজন আসামির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পিবিএআইয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, বাদীর পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া সন্দেহভাজন আসামিদের একটি পরিবারকে এখনো পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তাঁরা। তাদের গতিবিধি ও তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েও শনাক্ত করার কাজ করছেন। তবে গ্রেপ্তার করার মতো ক্লু পাননি। খুব শিগগির ওয়ালিদের হত্যা নিয়ে পিবিআইয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁরা একটি বৈঠক ডেকেছেন বলেও জানান তিনি।