‘বৃদ্ধ হচ্ছি কিন্তু মেয়ের বয়স তো আর বাড়ছে না’

বাবা খন্দকার লিয়াকত আলীর সঙ্গে প্রেরণা খন্দকার। এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতিছবি: সংগৃহীত

খন্দকার লিয়াকত আলী অনেক মানুষের মধ্যেও একা থাকেন। সারা রাত বারান্দায় হাঁটেন, গান শোনেন। ঘুরেফিরে বারবার দেখেন বাড়ির পূর্ব দিকের জায়গাটা। গত বছরের শুরুতে রাজধানী থেকে সব গুটিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন ৭০ বছর বয়সী মানুষটি। কয়েক বছর ধরে তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে আসতে হয় রাজধানীতে, যেতে হয় ভারতেও। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামে ফিরে যাওয়ার কারণ একটাই—দ্বিতীয় সন্তান প্রেরণা খন্দকার।

প্রেরণার ঝুলন্ত দেহটা নিজেই নামিয়েছিলেন খন্দকার লিয়াকত। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা তখনো বেঁচে আছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচানো যাবে। তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। ওর রুমে আলো জ্বলছিল, মিউজিক বাজছিল। কেন যেন সন্দেহ হলো। দরজা নক করে বুঝলাম ভেতর থেকে আটকানো। এরপর ডুপ্লিকেট চাবি এনে দরজা খোলা হলো। যে দৃশ্যটি শতচেষ্টাতেও আর কোনো দিন ভুলতে পারব না, সেই দৃশ্য দেখলাম।’

মা আসমা খন্দকারের সঙ্গে মেয়ে প্রেরণা খন্দকার। মেয়ের এভাবে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেন না মা
ছবি: সংগৃহীত

স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, চাকরি হারানো, বাবার ক্যানসার ধরা পড়া—ঘটনাগুলো প্রায় একই সময় ঘটেছিল প্রেরণার জীবনে। পরিবারের সবার ধারণা ছিল, মানসিকভাবে শক্ত প্রেরণা নিজেকে সামলে নেবেন। মানসিকভাবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল পরিবারও। কারও মনে শঙ্কা জাগেনি, রাতে মা–বাবার কাছ থেকে ‘হাসিমুখে’ বিদায় নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া মানুষটি এমন সিদ্ধান্ত নেবেন। শেষবারের মতো ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে মাকে দিয়ে নিজে খেয়েছিলেন। পরদিন সকালে বড় বোনের অফিসে যাবেন। কথা ছিল, সেখান থেকে দুই বোন বাইরে খেতে যাবেন। কিন্তু রাতে নিজের কক্ষে ঢুকে প্রেরণা সাদা কাগজে লিখেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না।’ ঘটনাটি ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির। তখন প্রেরণার বয়স হয়েছিল ২৮ বছর।

মেয়ের এই ছবির সামনে রোজ সকালে ফুল কুড়িয়ে এনে রাখেন প্রেরণার মা আসমা খন্দকার
ছবি: কবির হোসেন

সে ঘটনার পর চার বছর হতে চলেছে। এখনো স্বাভাবিক হয়নি প্রেরণার মা–বাবার জীবন। মেয়ের কবর মির্জাপুরের গ্রামের বাড়িতে। অক্টোবরে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, প্রেরণার মা আসমা খন্দকার মেয়ের ছবিতে ফুল দিয়ে রেখেছেন। প্রথম আলোকে তিনি জানালেন, তিনি প্রতিদিন ছবিতে ফুল দেন। দিনের অনেকটা সময় গিয়ে বসে থাকেন মেয়ের কবরের কাছে। মনকে সান্ত্বনা দেন, মেয়ে কাছেই আছে।

আসমা খন্দকার বললেন, ‘সময় চলে গেলে স্মৃতি হালকা হয়। কিন্তু সন্তান হারানোর কষ্ট মায়ের জন্য কোনো দিন কমে না। আমার মেয়েটা নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে খুব পছন্দ করত। ওর ব্যবহারের জিনিসগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় প্রেরণা আছে। ফিরে আসবে একটু পরেই। পরমুহূর্তে আবার কবরের দিকে চোখ যায়। কোনটা যে সত্যি, আমি বুঝতে পারি না।’

বাবা–মা ও ভাই–বোনের সঙ্গে ছোট্ট প্রেরণা ছবির ডান দিকে
ছবি: সংগৃহীত

প্রেরণার জন্মদিন ২৫ জুন। যমজ ভাইবোন তাঁরা। প্রেরণার ভাই প্রত্যয় খন্দকার বোনের মৃত্যুর ঘটনায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন রাতে বোনের মরদেহ তাঁকেও নামাতে হয়েছিল। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘সেই সময়ের সব কথা আমার স্পষ্ট মনেও নেই। মনে রাখা যায় না। শুধু বিশ্বাস করতে পারিনি, আমার বোন চলে গেছে। কোনো দিন আর দেখা হবে না আমাদের। একসঙ্গে জন্মেছিলাম। তাই ওর মৃত্যুর আগপর্যন্ত আমরা দুই ভাইবোন একসঙ্গে জন্মদিনের কেক কেটেছি।’

জন্মদিন প্রসঙ্গে খন্দকার লিয়াকত আলী আর কান্না সামলাতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘আমার মেয়ের প্রতিবছর দুশ্চিন্তা থাকত, ওর জন্মদিনে বড় আয়োজন করা হবে কি না তা নিয়ে। এখন প্রতিবছর ওর জন্মদিনের আগে আসে মৃত্যুদিন। আমি বাবা হয়ে তাই পালন করি। আমি বৃদ্ধ হচ্ছি, কিন্তু আমার মেয়েটার বয়স আর বাড়ছে না। এই বাড়িতে পায়চারি করি, গান গাই, আর ঘুরেফিরে মেয়ের কবরের দিকে তাকাই। বাড়ির পূর্ব দিকে ওর কবর। “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না” লেখা কাগজটার ছবি তুলে রেখেছি। ছবিটা দেখি আর চিন্তা করি, আসলেই কি কেউ দায়ী না?’