পাঠকের লেখা–৩৬
গ্রামের নাম ডাকিনীর পাট
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
আমাদের ডাকিনীর পাট গ্রামটি একসময় জুয়ার গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। মাসের পর মাস চলত জুয়াখেলা। সেটা কখনো অশ্লীল যাত্রাপালার নামে, কখনো ভিসিডি প্রদর্শনীর নামে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, প্রশাসন সবাই ছিল নির্বিকার। জুয়া আমাদের গ্রামের ওপর এমনভাবে চেপে বসেছিল যে আমরা কোথাও গেলে সাধারণত নিজেদের গ্রামের পরিচয় দিতে চাইতাম না। কারণ, নাম শুনলেই যে কেউ বলে উঠত, ওটা তো জুয়ার গ্রাম। আচ্ছা ওখানে কি কোনো ভালো মানুষ নেই?
লজ্জায় কান দুটো লাল হয়ে যেত! মাথা নিচু করে চলে আসতাম।
সম্ভবত ১৯৯৫ সাল। নুর হোসেন সরকার, আমিরুল ইসলাম, মন্টু ব্যাপারী, নুর জামাল ও আমি—এই পাঁচজন সিদ্ধান্ত নিই, যে করেই হোক, এলাকায় জুয়া বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রথমে গ্রামের সব শ্রেণি-পেশার লোকের সঙ্গে কথা বলি এবং জুয়াবিরোধী জনমত গঠন করি। সবাই এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায়। প্রয়োজন হলে পাশে থাকারও আশ্বাস দেয়।
আশ্বিন মাস। প্রকৃতিতে শরতের শুভ্রতা। ডাকিনীর পাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সাড়ম্বর জুয়া ও ভিসিডি প্রদর্শনী চলছে। আনুমানিক রাত আটটায় আমরা পাঁচজন রওনা দিই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। পথে যোগ দেন নন্দনপুর হাইস্কুলের শিক্ষক প্রফুল্ল বর্মণ। মাঠে দেখি, অনেক লোকের সমাগম। কেউ ভিসিডি দেখছে, কেউ ব্যস্ত জুয়াখেলায়। জুয়ার বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে একজন উচ্চস্বরে হাঁকছে, ‘ধরলেই পাবেন, ধরলেই পাবেন। ১০০ ধরলে ২০০, ৫০০ ধরলে হাজার।’ আমরা দৃঢ়পায়ে তার কাছে যাই। আয়োজকদের উদ্দেশে বলি, জুয়া বন্ধ করতে হবে।
তাদের একজন বলে ওঠে, ‘কেন?’
‘জুয়াখেলা অন্যায়, আইনত দণ্ডনীয়। জুয়ায় তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই এলাকায় আর জুয়া হতে দেব না।’
‘আমাদের থানার অনুমতি আছে।’
‘দেখি অনুমতি।’
লোকটি সুচতুরভাবে কথার মোড় ঘুরিয়ে পাশে বসে থাকা ক্যাশিয়ারকে বলে, ‘ওনাদের এক হাজার টাকা দে।’
‘আমাদের কিনতে চাইছেন?’
‘না, মানে, সবাই তো এসে প্রথমে আপনাদের মতো জুয়া বন্ধ করার কথা বলে, কিন্তু টাকা পেলে চলে যায়।’
‘আমরা টাকা চাইতে নয়, জুয়া বন্ধ করতে এসেছি। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন।’
আমাদের দৃঢ়তা দেখে তারা আর কথা না বাড়িয়ে সব গুছিয়ে সদলবল চলে যায়। পরদিন সকাল না হতেই সংবাদটি চাউর হয়ে যায়। সবাই বলতে থাকে, গত রাতে ছেলেরা অসাধ্য সাধন করেছে। এলাকা থেকে জুয়া উৎখাত করেছে।
দুদিন পর বিকেলে সংবাদ আসে, এবার আশপাশের সব এলাকার জুয়াড়িরা জোট বেঁধেছে। কাল মাঠে আবার জুয়া বসাবে। কেউ বাধা দিতে গেলে রেহাই পাবে না। কারণ, এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরাও সাফ জানিয়ে দিই যে হুমকিতে আমরা ভয় পাই না। ফয়সালা যা আগামীকাল মাঠেই হবে।
পরদিন সকাল থেকে জুয়াড়িরা তৎপর। বিকেলের মধ্যেই তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন। মাইকিং, লাইটিং, লোক জমায়েত, শামিয়ানা টানানোসহ কোনো কিছুই বাদ যায় না। এশার পরই মহাসমারোহে শুরু করবে জুয়া। অপর দিকে সন্ধ্যার পর আমরা অবস্থান নিই ডাকিনীর পাট জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। আসর বসালেই যাব বাধা দিতে। আমাদের দৃঢ় পণ।
এশার নামাজ শেষ। দু-একজন করে মুসল্লি বের হওয়া শুরু করেছেন। হঠাৎ মাঝ আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ জমতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছেয়ে যায় পুরো আকাশ। শুরু হয় বিদ্যুৎ চমকানো আর বর্ষণ। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। লন্ডভন্ড হয়ে যায় জুয়াড়িদের সব আয়োজন। ক্ষোভ নিয়ে তারা ফিরে যায় বাড়িতে।
পরদিন জুয়াড়িদের মরণপণ প্রস্তুতি। আজ যেভাবেই হোক জুয়া বসাতে হবে। আমরা অবস্থান নিই মসজিদ প্রাঙ্গণে। কিন্তু নামাজ শেষ না হতেই শুরু হয় থেমে থেমে বৃষ্টি আর বাতাস। আশ্বিনের এমন রূদ্ররূপ কেউ দেখেনি কোনো দিন।
দিনভর জুয়াড়িদের ব্যাপক প্রস্তুতি আর রাতে বৃষ্টি, এভাবে চলে মাসাধিককাল। একসময় জুয়াড়িদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা ঘোষণা দেয়, ‘জীবনে অনেক পাপ করেছি, আর নয়। জুয়া ছেড়ে দিলাম। ভালো মানুষ হব।’
ডাকিনীর পাট এখন অগ্রসর গ্রাম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিতে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। পরিবর্তন এসেছে জীবনমানেও। ডাকিনীর পাটে বড় বাজার হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অনেকের কর্মসংস্থান। ডাকিনীর পাটকে এখন আর কেউ জুয়ার গ্রাম বলে না।
রিজভী আহমেদ, সহকারী শিক্ষক, জামতলা নিম্নমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম