ডাউকি বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছালাম। মিত্রবাহিনীর অন্যান্য অফিসারও যথারীতি উপস্থিত। (ছোটখেলের পাকিস্তানে অবস্থান ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্টের অধিকারে আসার পরও আবার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায়) সবাই বিমর্ষ। পরিস্থিতি থমথমে। জেনারেল গিল ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্টের বিপর্যয়ের জন্য কাউকেই দোষারোপ করলেন না।
তিনি শুধু বললেন, ছোটখেল অবস্থানটি ধরে রাখতে না পারার কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছিল না। এই অবস্থান দখল করতে গিয়ে গোর্খাদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। জেনারেল গিল গোর্খা রেজিমেন্টের সিও কর্নেল রাওকে এ জন্য সহানুভূতি জানালেন।
এরপর সেদিনই (২৮ নভেম্বর) ভোররাত সাড়ে চারটায় দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে আবার রাধানগর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন তাঁকে। তাঁদের আক্রমণে সাহায্যকারী হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট গোলাবর্ষণ করবে। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর তিনটি এফএফ কোম্পানি এবং তৃতীয় বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি নিজ নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে গোর্খাদের ফায়ার সাপোর্ট দেবে।
এরপর তিনি আমাকে লুনি, দুয়ারিখেল ও গোরা গ্রামে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের সব সেনাসদস্যকে সংগঠিত করে একযোগে ছোটখেল আক্রমণ করে সেটা দখল করার নির্দেশ দিলেন। তবে আমাদের কোনো আর্টিলারি সাপোর্ট দেওয়া হবে না বলে জানালেন গিল। অর্থাৎ কোনো ফায়ার সাপোর্ট ছাড়াই আমাদের একটি প্রথাগত আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে, যাকে নীরব আক্রমণ বলা চলে।
ওই গ্রাম তিনটিতে তৃতীয় বেঙ্গলের ডেলটা কোম্পানি এবং আরও দুটো প্লাটুন অবস্থান করছিল। অপারেশনের অর্ডার নিয়ে রাত প্রায় একটার দিকে আমি নবির অবস্থানে পৌঁছালাম। গোরা গ্রামে তখনো থেমে থেমে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলছিল। দুয়ারিখেল যে এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে গেছে, সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সন্ধ্যার আগে সেখানে অবস্থানরত প্লাটুনটি পশ্চাদপসরণ করে লুনি গ্রামে অবস্থানরত ডেলটা কোম্পানির সঙ্গে একত্র হয়।
নবির বাংকারে বসেই সব প্লাটুন কমান্ডারকে খবর পাঠালাম। তাঁরা এলে গিলের নির্দেশের কথা জানালাম। প্রায় সবাই একবাক্যে এই আক্রমণ কয়েক দিনের জন্য স্থগিত রাখার কথা বললেন। তাঁদের যুক্তি, গত প্রায় দেড় মাস অনবরত পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ করে আমাদের সেনাসদস্যরা খুবই পরিশ্রান্ত। অনেকেই আহত অথবা নিখোঁজ। সৈন্যদের খাওয়াদাওয়াও ঠিকমতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক সময় অভুক্ত থেকেই তাঁদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কয়েক দিনের বিশ্রামের পরই এ রকম একটা আক্রমণে যাওয়া যুক্তিসংগত হবে না বলে প্লাটুন কমান্ডাররা অভিমত ব্যক্ত করলেন। তাঁদের বক্তব্য যথেষ্ট যুক্তিসংগত ছিল। তবু আমাদের এই আক্রমণে যেতেই হবে। আমাদের মাতৃভূমির মুক্তির জন্য বিদেশি গোর্খারা আবারও রাধানগর আক্রমণে যাচ্ছে আর আমরা আক্রমণ স্থগিত রাখার জন্য যুক্তির অবতারণা করছি! অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সবাইকে উৎসাহিত করার জন্য বললাম, কোম্পানির কমান্ডার লে. নবির সঙ্গে আমিও এই আক্রমণে অংশ নেব। ভোররাত চারটার মধ্যে সবাইকে নবির বাংকারের কাছে নিচু জমিটায় সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলাম।
তৃতীয় বেঙ্গলের ছোটখেল দখল
নবির অবস্থানে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেওয়ার পর বের হয়ে দেখলাম, ডেলটা কোম্পানির সদস্যরা আক্রমণে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছেন। এখন নির্দেশের পালা। এফইউপির উদ্দেশে রওনা দিলাম। এক সারিতে প্রায় ১৫০ যোদ্ধা। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করতেই রাধানগরের ওপর মিত্রবাহিনীর কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর আমরা এক্সটেন্ডেড লাইনে ছোটখেলের শত্রু অবস্থানগুলোর দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। লাইনের একেবারে বাঁয়ে ছিলাম আমি। মাঝখানে কোম্পানি কমান্ডার লে. নবি।
শত্রুর অবস্থান আর মাত্র ৩০০ গজ দূরে! ‘জয় বাংলা’, ‘ইয়া হায়দার’, ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে চারদিক কাঁপিয়ে তৃতীয় বেঙ্গলের ডেলটা কোম্পানি বেয়নেট উঁচিয়ে ফায়ার করতে করতে শত্রু অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েকটি বাংকারে রীতিমতো হাতাহাতি যুদ্ধ হলো। ডেলটা কোম্পানির সৈন্যরা তখন এক অজেয়, অপ্রতিরোধ্য শক্তি। কোনো বাধাই তাঁদের আটকে রাখতে পারছে না। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ছোটখেলের শত্রু অবস্থানগুলোর পতন হলো। গোর্খারা যে অবস্থান দখলের লড়াইয়ে মাত্র এক দিন আগে পরাজিত হয়েছিল, আজ সেটা আমাদের হাতের মুঠোয়। তৃতীয় বেঙ্গলের ডেলটা কোম্পানি প্রমাণ করল, বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা বিশ্বের অন্য যেকোনো রেজিমেন্টের তুলনায় কোনো অংশে কম নন। অতুলনীয় তাঁদের সাহস, নিষ্ঠা আর দেশপ্রেম।
পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে দূরের কাশবনের আড়ালে পালিয়ে গেল। তাঁদের বেশ কয়েকজন আমাদের হাতে ধরা পড়েন। গ্রামের সর্বত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের মৃতদেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে ছিল। ছোটখেল দখলের পর পাকিস্তানি সেনাদের প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ আর খাদ্যসামগ্রী ডেলটা কোম্পানির হাতে আসে, যা দিয়ে অন্তত কয়েক মাস যুদ্ধ করা সম্ভব। পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত বাংকারগুলোয় চারজন ধর্ষিত নারীর লাশ পাওয়া গেল। অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর বর্বর পাকিস্তানি সেনারা পালানোর সময় তাঁদের হত্যা করে যায়।
আমি আহত হলাম
বিজয়–আনন্দের আতিশয্যে কয়েকজন সৈন্য কয়েকটা খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জ্বলন্ত খড়ের গাদার আগুনে এলাকাটা আরও আলোকিত হয়ে উঠল।
আমি পাকিস্তানি সেনাদের একটি বাংকারের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখছি। বালুর বস্তা, বাঁশ, ভারী কাঠ দিয়ে তৈরি বাংকারগুলো। মর্টারের শেলও ওগুলোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বলে মনে হলো। চারদিকে তখনো বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি চলছে। আগুনের আলো লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সেনারা দূর থেকে গুলি ছুড়ছিল। হঠাৎ করেই ডান কোমরে প্রচণ্ড এক আঘাত পেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। ওঠার চেষ্টা করেও পারলাম না। বুঝতে পারলাম, গুলিবিদ্ধ হয়েছি। শুয়ে থেকেই নড়াচড়া করে বুঝলাম, হাড় ভাঙেনি। বুলেটটা ভেতরেই রয়ে গিয়েছিল। প্রবল যন্ত্রণা হচ্ছিল এ সময়।
আমার ব্যাটালিয়নের ডাক্তার ওয়াহিদ তখন লুনিতে। কয়েকজন সহযোদ্ধা আমাকে ধরাধরি করে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। আমার আগে আরও চারজন আহত সৈন্যকে সেখানে আনা হয়েছে। ওয়াহিদ সবাইকে ফার্স্ট এইড দিল। তীব্র যন্ত্রণা কমানোর জন্য আমাকে পেথিডিন ইনজেকশন দেওয়া হলো। সেই অবস্থায় একটা চিঠিতে নবিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। পাল্টা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে লিখলাম তাঁকে। এই অসাধারণ বিজয়ের গৌরব যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও ধরে রাখার নির্দেশ দিলাম। আরও বললাম, আমার আহত হওয়ার কথা যেন সৈন্যরা জানতে না পারেন। কারণ, তাহলে তাঁদের মনোবল ক্ষুণ্ন হতে পারে। আহত অবস্থায় চিঠিটা লিখি বলে হস্তাক্ষর খুব খারাপ হয়েছিল। ইংরেজিও হয়তো দু–একটা ভুল হয়ে থাকতে পারে। চিঠিটা খুব সম্ভব নবির কাছে এখনো আছে। ওই সময় আমার স্ত্রীকেও একটা চিঠি লিখি। সে তখন ব্যাটালিয়নের এলওবির সঙ্গে বাঁশতলার জঙ্গলে অবস্থান করছিল। তাঁরা যাতে কোনো দুশ্চিন্তা না করেন, সে জন্যই চিঠিটা লেখা।
শিলং মিলিটারি হাসপাতালে
সকাল ১০টার দিকে কয়েকজন সহযোদ্ধা স্ট্রেচারে করে আমাকে ডাউকি সীমান্তে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে আহত অপর চার সৈন্য। সীমান্তের কাছে পৌঁছে দেখলাম, খোলা একটা জায়গায় কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে জেনারেল গিল দাঁড়িয়ে আছেন। একটু দূরে তাঁর হেলিকপ্টার। যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে এসেছেন তিনি। তাঁকে ছোটখেল যুদ্ধে আমাদের সাফল্যের সংবাদ দিলাম। ছোটখেল দখলের বিবরণ শুনে গিল উল্লসিত হয়ে অভিনন্দন জানালেন। তাঁর কাছেই শুনলাম, গোর্খারা রাধানগরে দ্বিতীয়বারের মতো পর্যুদস্ত হয়েছে। এবারও প্রচুর হতাহত হয়েছে তাদের পক্ষে।
গিল তাঁর হেলিকপ্টারে করে আমাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। গিলের হেলিকপ্টারচালক অন্য আহত সহযোদ্ধাসহ আমাকে তুলে নিয়ে শিলং মিলিটারি হাসপাতালে নামিয়ে দেন। হাসপাতালে পৌঁছাই দুপুর ১২টার দিকে। সেখানে গোর্খা রেজিমেন্টের একজন জেসিওর সঙ্গে দেখা হলো। রাধানগর অপারেশনে তার একটা হাত উড়ে গিয়েছিল। সে আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার, আপ ভি ইধার আ গিয়া।’
দুপুরের দিকে হাসপাতালে পৌঁছালেও প্রায় ২০ ঘণ্টা পর অপারেশন টেবিলে তোলা হয় আমাকে। ২৬ নভেম্বরের যুদ্ধে আহত গোর্খাদের ডিসপোজাল করতেই এত সময় লেগে যায়। ২৯ নভেম্বর দুপুর নাগাদ জ্ঞান ফিরলে জানতে পারলাম, আমার শরীর থেকে বুলেটটা বের করা হয়েছে এবং শিগগিরই সেরে উঠব আমি। হাসপাতালে ফুলের তোড়া নিয়ে জেনারেল গিল আমাকে দুই দিন দেখতে এসেছিলেন।
১ ডিসেম্বরের পর থেকে তাঁকে আর দেখছিলাম না। খোঁজখবর করলাম। কিন্তু কেউ কিছু বলছিলেন না। বোধ হয় নিজেদের গোপনীয়তা ভাঙতে চান না আরকি! কয়েক দিন পর জানতে পারলাম, ময়মনসিংহের কামালপুর সাবসেক্টরে একটি অপারেশন পরিচালনা করতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে জেনারেল গিলের পা উড়ে গেছে। প্রবীণ, সাহসী এই জেনারেলের দুর্ঘটনার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
(সংক্ষেপিত)
সূত্র: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ: রক্তাক্ত মধ্য–আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, শাফায়াত জামিল সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮
শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম: প্রয়াত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল; বীর মুক্তিযোদ্ধা।