ঈদযাত্রায় বাসে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া, কোথাও দেড় থেকে দুই গুণ
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে শেরপুরগামী সোনার বাংলা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন দুই চাচাতো ভাই মিলন মিয়া ও উজ্জ্বল মিয়া। তাঁদের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। তবে কোনো টিকিট দেওয়া হয়নি। একই বাসের যাত্রী লিমন খানের কাছ থেকেও এক হাজার টাকা নেওয়া হয়। তাঁর টিকিটে শুধু আসন চিহ্নিত করা, ভাড়া উল্লেখ নেই।
এই তিনজন ছাড়াও বাসের ভেতরে থাকা আরও প্রায় ১৩-১৪ জন যাত্রীর কাছ থেকে জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেউ টিকিট পেয়েছেন, কেউ আবার পাননি। যাঁদেরকে টিকিট দেওয়া হয়েছে, তাঁদের টিকিটেও ভাড়ার পরিমাণ উল্লেখ নেই।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে শেরপুরের দূরত্ব ২২৭ কিলোমিটার। নির্ধারিত ভাড়া ৬১৬ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে শেরপুর যেতে ভাড়া লাগে ৫০০-৫৫০ টাকা। তবে ঈদ উপলক্ষে এই গন্তব্যের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা। যা বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া থেকে দেড়গুণ এবং স্বাভাবিক সময় থেকে প্রায় দ্বিগুণ।
সোমবার বিকেল ৪টার দিকে সোনার বাংলা পরিবহনের বাসটি ময়মনসিংহগামী এনা পরিবহনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো ছিল। বাস ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে যাত্রী ডাকাডাকি করছিলেন বাসটির কর্মীরা।
তখন বাসের ভেতরে থাকা মিলন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতে ভাড়া মাত্র সাড়ে ৫০০ টাকা। ঈদ এলেই ভাড়া বাড়াই দেয়। কিন্তু উপায় তো নেই। বাড়িত তো যাইতে হইব।’
বাসের ভেতরে যাত্রীদের আসন বুঝিয়ে দিয়ে ভাড়া আদায় করছিলেন বাসটির চালকের সহকারী সাঈদ আলী। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অনেকটা বিরক্তির সুরে তিনি বলেন, ‘ফেরার সময় যাত্রী নাই। তখন গাড়ি পুরাই খালি থাকে। কিন্তু গাড়ি তো আর হাওয়ায় চলে ঢাকায় আসে না।'
সাঈদের সঙ্গে কথা বলার সময়ই অনেকটা হম্বিতম্বি করে বাসের ভেতরে ঢোকেন আরেক ব্যক্তি। টিকিট বিক্রির জন্য সাঈদকে বকাঝকা করে তিনি বলেন, ‘তোরে কে টিকিট বেচতে বলসে? সব যাত্রী নামা।’ পরে প্রতিবেদকের কাছে নিজের নাম বিল্লাল হোসেন বলে জানান এবং নিজেকে ওই গাড়ির কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন।
বিকেলে শেরপুরগামী সোনার বাংলা ছাড়াও মহাখালী থেকে নেত্রকোনা, বিরিশিরি, হালুয়াঘাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নান্দাইল, মুক্তাগাছা ও কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া সব পরিবহন কোম্পানির বাসে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে দেখা গেছে। বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী ঢাকা-হালুয়াঘাটের ভাড়া ৪৫১ টাকার জায়গায় ৭০০ টাকা নেওয়া হচ্ছিল। হালুয়াঘাটগামী শ্যামলী বাংলা ও ইমাম পরিবহনের কর্মীরা শুধু ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৫০০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী ডাকাডাকি করছিলেন।
মহাখালী টার্মিনালে এনা পরিবহনের টিকিট কাউন্টারের সামনে নারী ও পুরুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। বিকেল ৪টার দিকে এনার ৮৭ নম্বর বাস ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এই পরিবহনে স্বাভাবিক সময়ের মতোই নির্ধারিত ৩১০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।
যাত্রী হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে মহাখালী টার্মিনালে ছিল বিআরটিএ’র একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিআরটিএ’র এনফোর্সমেন্ট শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত-৬) সাজিদ আনোয়ার। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলে তারা কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন—এ বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়।
জবাবে সাজিদ আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীরা নিয়ন্ত্রণকক্ষে ফোন করে অভিযোগ জানাচ্ছেন। কেউ কেউ টার্মিনালে এসে সরাসরি অভিযোগ করছেন। এ ছাড়া বিআরটিএ’র কর্মীরাও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে তদারকি করছেন। সোনার বাংলাসহ অন্যান্য পরিবহনে বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি জানানো হলে তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
তবে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সোনার বাংলার বাসটি গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতে দেখা যায়। অবশ্য বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মুঠোফোনে সাজিদ আনোয়ার প্রথম আলোর প্রতিবেদককে জানান, সোনার বাংলার বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। কয়েকজন যাত্রীর টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করছেন। তখন ওই কর্মকর্তাকে জানানো হয় যে, বাস আগেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই পরিবহনের অন্য আরেকটি বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান।
এর আগে দুপুরে গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়েও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন পরিবহনের বাসে যাত্রীদের কাছ থেকে ১০০-২০০ টাকা বাড়তি ভাড়া নিতে দেখা গেছে।
গাবতলী থেকে চুয়াডাঙ্গাগামী সুমন ডিলাক্স নামের একটি পরিবহনের দুটি টিকিট কেনেন আবদুর রহমান। তাঁর কাছ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা নেওয়া হয়। অথচ টিকিটে দেড় হাজার টাকা লেখা ছিল।
জানতে চাইলে সুমন ডিলাক্স পরিবহনের গাবতলীর কাউন্টার ব্যবস্থাপক মাসুম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৫৫ কিলোমিটার দূরত্বের চুয়াডাঙ্গায় বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়া ৭৫৫ টাকা। কিন্তু আমরা নিচ্ছি ৭৫০ টাকা।’ ঈদ উপলক্ষে কিছু টাকা ‘বকশিশ হিসেবে’ বাড়তি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।