আমরা একাত্তর সালে স্বাধীন হয়েছি। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। মাঝের ২৬৬ দিন ছিল তার গর্ভযন্ত্রণার কাল।
প্রতিবছর ধুমধাম করে আমরা দিবসটি উদ্যাপন করি। রঙিন আলোয় ভবনের দেয়াল দিই ঢেকে। রাস্তায় নিশান ওড়াই। আতশবাজি পোড়াই। কুচকাওয়াজ করি। ক্রোড়পত্র ছাপাই। বাণী দিই। কিন্তু এর পেছনে যে অগুনতি মানুষের লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা, কান্না, রক্ত লুকিয়ে আছে, অনেক সময় তা আড়ালে চাপা পড়ে থাকে। আমরা উৎসব করি। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা মনে রাখি কয়জন!
৫২ বছর হয়ে গেল। আর কত দিন এভাবে চলবে? আরও ৫২ বছর কিংবা ১০০ বছর? তারপর? একাত্তরের প্রজন্ম যে আবেগ লালন করে, সেটি একসময় আর থাকবে না। তখন স্বাধীনতা দিবসের উদ্যাপন কেমন হবে?
বাংলাদেশ তো চিরকাল পরাধীন ছিল না। একাত্তরে প্রথমবার স্বাধীন হয়নি। পুরো ইতিহাসটা আমাদের সামনে তুলে ধরলে বোঝা যেত। ত্রয়োদশ শতকে এ দেশ তুর্কি শাসকদের অধীনে চলে যায়। পরে কিছুকাল ছিল স্বাধীন সুলতানি আমল। আমরা ইলিয়াস শাহর কথা জানতে পারি। ওই সময় বাংলাকে দরবারের ভাষা করা হয়েছিল। মোগলরা বাংলা দখল করার পর আমরা দিল্লির শাসনে চলে যাই। মোগল বাদশাহর একজন সুবাদার, নায়েবে নাজিম কিংবা নবাব এ দেশ শাসন করতেন। বাদশাহ আকবরের সময় থেকে এ রকম চলে আসছিল। শাসকেরা ছিলেন বিদেশি। তাঁরা কেউ তুর্কি, কেউ আফগান, কেউ ইরানি-তুরানি-উজবেক। দরবারের ভাষা হয়ে গেল ফারসি। তাঁদের সঙ্গে জুটে যেত অনেক সৈন্যসামন্ত, বরকন্দাজ। তারাও বহিরাগত, মার্সেনারি। আজ এই শাসক তো কাল ওই শাসকের পেছনে জড়ো হতো, যখন যেখান থেকে টাকা বা জমি পেত। তারা একজনকে হটিয়ে কিংবা খুন করে আরেকজনকে শাসক বানাত। স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সংযোগ ছিল না।
১৭৫৭ সালে আমরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে কলোনি হওয়ার প্রক্রিয়ায় ঢুকি। এই প্রক্রিয়া চলেছিল ১০০ বছর। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যে আর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব নেই, এই খবর নেত্রকোনার গ্রামে পৌঁছাতে লেগেছিল হয়তো ৩০ বছর। মানুষের কাছে সরকার বা শাসক ছিল সেই লোক, যে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। সময়মতো খাজনা দিতে না পারলে তার ভিটায় ঘুঘু চরাত।
১৮৫৮ সালে বাংলা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পুরোপুরি উপনিবেশ। তারা এ দেশে নানান আইনকানুন চালু করে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। চালু করে পুলিশ বাহিনী, পেনাল কোড, বিচারালয়, স্থানীয় সরকার—আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। স্বাধীনতার ধারণা ও দাবি তখন থেকে। এরপর আমরা দুবার স্বাধীন হই। প্রথমবার ১৯৪৭ সালে। দ্বিতীয়বার ১৯৭১ সালে। দুবারই পাওয়া গেছে ভৌগোলিক স্বাধীনতা; অর্থাৎ আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র ও সার্বভৌম সরকার পেয়েছি।
আমরা মননে, আবেগে, কথায় ইলিয়াস শাহি স্বাধীনতা কিংবা পলাশীর পরাজয় নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। এসব এখন অতীত। এ দেশের মুসলমানরা ১৯৩০-৪০-এর দশকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে আমরা পরিচিত প্রতিবেশীকে ছেড়ে দূরবর্তী পাঞ্জাব, সিন্ধি আর পাঠানদের সঙ্গে সিনায় সিনা মিলিয়ে একজোট হয়েছিলাম। তারপর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের বড় লাট জিন্নাহ সাহেব সৈন্য পাঠিয়ে কালাতের আমিরকে ধরে এনে তাঁকে দিয়ে একটা কাগজ সই করিয়ে দিয়ে বানান বেলুচিস্তান প্রদেশ। আমরা হলাম পাঁচের মধ্যে এক।
বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যরা দুবার গণহত্যা চালিয়েছে। কারণ, বালুচরা স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। বাংলায় তার প্রতিবাদ হয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। তখন কিন্তু মূলধারার পাঠান আর বালুচ নেতারা আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা একাত্তরে শুধু আওয়ামী লীগকেই নিষিদ্ধ করেনি, নিষিদ্ধ হয়েছিল পাঠান নেতা ওয়ালি খান আর বালুচ নেতা গাউস বখশ বিজেঞ্জোর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও। যাহোক, সামরিক জান্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা অগুনতি মানুষের ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে সাতচল্লিশের প্রায়শ্চিত্ত করেছি। হয়তো এখনো করে যাচ্ছি।
একটা কথা প্রায়ই শুনি, সাতচল্লিশ না হলে একাত্তর হতো না। কালপঞ্জি অনুযায়ী এটা সঠিক। কিন্তু এর পেছনে দৃষ্টিভঙ্গি আর রাজনীতিও কাজ করে; অর্থাৎ ভারতের মুসলমানের আলাদা দেশ হবে পাকিস্তান। একাত্তরের পরও বাঙালি মুসলমান তা ভোলেনি। হওয়ার কথা ছিল মুসলমানের দুটি দেশ। কিন্তু বাংলার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর সমর্থকদের অতি উৎসাহে হয়ে গেল একটা পাকিস্তান। সেটা ভাঙতে লাগল ২৪ বছর। এ দেশে এখনো সোহরাওয়ার্দী-বন্দনা হয়। এই একটি লোক আমাদের যে কত পিছিয়ে দিয়েছিলেন, তার অনুসন্ধান একদিন না একদিন নিশ্চয়ই হবে।
একাত্তর আমাদের অনেক কিছু ফয়সালা করে দিয়েছে। আবার অনেক কিছুই করেনি। আমরা ১৯৪০-এর দশকে মুসলমানের আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। তারপর আমাদের হুঁশ হলো। দেখলাম, অবাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের অনেক ফারাক। একাত্তরে এসে আমরা বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র পেয়েছি। এটি অবশ্য ৩০ কোটি বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র হয়নি। হয়তো এটাই ছিল নিয়তি। তারপরও বাঙালি বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে যে কুতর্ক হয়, তার পেছনে কোনো দর্শন নেই। আছে কেবল মতলবি রাজনীতি।
তারপরও থেকে গেছে অনেক জিজ্ঞাসা। আমাদের একটি সংবিধান আছে। আমরা এটিকে পবিত্র গ্রন্থ মনে করি। যদিও এটা ১৭-১৮ বার কাটাছেঁড়া হয়েছে। আরও হবে। তবে সংবিধানে তো আর সব জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া যায় না! সংবিধানে আছে, বাংলাদেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র, সেখানে রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম। বাঙালি নেতারা কখনো সেক্যুলার রাষ্ট্র বানাতে চাননি। হয়তো তাঁরা সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার পার্থক্য বোঝেন না। যাহোক, বাংলাদেশ হয়ে গেছে মুসলমানের দেশ, বাঙালি মুসলমানের। অমুসলমান যাঁরা আছেন, কাজির খাতায় তাঁদের সম-অধিকারের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তাঁরা সংখ্যাগুরুর ‘গনিমতের মাল’।
বেলুচিস্তানে দুবার গণহত্যা হলো। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে। দ্বিতীয়বার ১৯৫৬ সালে। ব্রিগেডিয়ার টিক্কা খান সেবার নৃশংসভাবে বালুচদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করেছিলেন। এ জন্য তাঁর নাম হয়ে যায় ‘বেলুচিস্তানের কসাই’। দুবারই পাকিস্তানে ছিল সাংবিধানিক সরকার। সেখানে বাঙালি মন্ত্রীও ছিলেন।
বালুচরা পাকিস্তানের খাঁচা থেকে বের হতে পারেনি। বাংলাদেশে একবার গণহত্যা হলো একাত্তরে। আমরা পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে এলাম। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, বেলুচিস্তানের সঙ্গে যদি ভারতের সীমান্ত থাকত, তাহলে তারা হয়তো ১৯৪৮ সালেই আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারত। একই সঙ্গে মনে প্রশ্ন জাগে, একাত্তরের ক্র্যাকডাউনের পর ভারত যদি সীমান্ত খুলে না দিত, তাহলে কী হতো? আমাদের তো বার্মার সঙ্গেও সীমান্ত ছিল। আমরা তো আশ্রয় ও সাহায্যের জন্য সেখানে যাইনি? ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউন আর ভারতের সীমান্ত খুলে দেওয়ার শর্ত দুটির যেকোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে কী হতো?
একটি রক্ষণশীল সমাজে বিরাজমান ‘ডিসকোর্স’ বা শিখিয়ে দেওয়া বয়ান নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না। প্রশ্ন করলেই তার কপালে দেশদ্রোহের তিলক লাগিয়ে দেওয়া হয়। প্রশ্নহীন সমাজ বদ্ধ জলাশয়ের মতো। সেখানে ঢেউ ওঠে না। ক্রীতদাস কোনো প্রশ্ন করে না। স্বাধীন মনের মানুষের চিত্তের খিদে এমন যে সে প্রশ্ন করবেই। সব প্রশ্নের জবাব হয়তো আজই পাওয়া যাবে না। আবার যুক্তিহীন জবাব জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দিলেও মানুষ তা গিলবে না।
বাঙালি একদিন হঠাৎ জেগে উঠল, একটা ভাষণ কিংবা ঘোষণা শুনল, বাঙালি সৈনিকেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, প্রবাসে একটা সরকার তৈরি হলো, তারপর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করল। ৯ মাসের যুদ্ধে দেশটা স্বাধীন হয়ে গেল। বিষয়টা কি এতই সরল?
একাত্তরে এ দেশে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধ চলেছিল। তার মধ্যেই বাংলাদেশের জন্ম। যুদ্ধটা শুধু ঢাকা বনাম ইসলামাবাদ ছিল না। যুদ্ধ হয়েছে কলকাতা, দিল্লি, বেইজিং, মস্কো, ওয়াশিংটনে। কূটনৈতিক লড়াই হয়েছে নিউইয়র্কে, জাতিসংঘে। মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়া সংকটের ফয়সালা করতে পারেননি। এতে জড়িয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী, চৌ এনলাই, আলেক্সি কোসিগিন, আন্দ্রে গ্রোমিকো, রিচার্ড নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জার। ইন্দিরার সঙ্গে ছিলেন চারজন কুশলী আমলা—কাশ্মীরি পণ্ডিত পি এন হাকসার, ডি পি ধর, আর এন কাও, টি এন কাউল।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সরকার ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান যখন শর্তহীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তুলল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে, তার পক্ষে পড়েছিল ১১১টি ভোট। বিপক্ষে মাত্র ১৪টি—ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলো।
সাধারণ পরিষদে বিপুল ভোটে জিতে পাকিস্তান যখন এই প্রস্তাব নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। তারপরই জেনারেল নিয়াজি জাতিসংঘের কাছে ধরনা দেয়, তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার আবেদন জানায়। সেটি হয়নি ভারতের কারণে। কারণ, ভারত যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়নি। তখন মুক্তিবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ভারতীয় বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে আসছে ঢাকার দিকে। তারপর নিশ্চিত হয়ে যায় পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয়। বাঙালি যা চেয়েছিল, তা পেল। ভারত যা চেয়েছিল, সেটাও তারা পেল। কেমন করে এই দুই লক্ষ্য এক মোহনায় এসে মিলে গেল, তার সুলুকসন্ধান করলেই আমাদের জন্ম-ইতিহাস অনেকটা জানা হয়ে যাবে।
বাঙালির প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তাঁর সে ম্যান্ডেট ছিল। এখানে দুটি বাধা ছিল। প্রথমত, তিনি সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করতেন না। বড় একটা সামরিক বাহিনীর বোঝা নিয়ে তিনি স্বস্তিতে পাকিস্তানের প্রশাসন চালাতে পারতেন না। তাঁর মনে হয়েছিল, সামরিক বাহিনী সব সময় তাঁর ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলবে এবং যেকোনো ছুতায় তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবে। পাকিস্তান ভাঙা তাঁর জন্য জরুরি ছিল।
পাকিস্তান অখণ্ড থাকলে ভুট্টোকে আজীবন বিরোধী দলের বেঞ্চে বসতে হতো। অথবা তাঁকে পাঞ্জাব বা সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। জিন্দেগিতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টো চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতা।
অখণ্ড পাকিস্তান ছিল ভারতের গলার কাঁটা। তদুপরি ছিল বৈরী চীন। এ জন্য গরিব দেশ ভারতকে সব সময় একটা বড় সামরিক বাহিনী পুষতে হতো।
সে জন্য পাকিস্তান ভাঙা মুজিব, ভুট্টো ও ভারত—সবার জন্য ছিল মঙ্গলের এবং সেটাই হলো। যে যা চেয়েছিলেন, তা পেলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব হলেন জাতির জনক। পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে ভুট্টো হলেন কায়েদে আওয়াম। যুদ্ধজয়ী ইন্দিরা হলেন ভারতরত্ন। কিন্তু এ জন্য অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে প্রাণ দিতে হলো। রাজনীতিবিদ ও জেনারেলদের দাবা খেলায় জান গেল অনেক সৈনিকের। এ রকম একটি আয়োজন তিন-চারজনের গোপন মিটিং করে, নীলনকশা বানিয়ে করা যায় না। দুই দশকের ধারাবাহিক ঘটনাবলির অনিবার্য গন্তব্য ছিল একাত্তর। এটা হতোই। এই দুই দশকের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অনেক তথ্য, অনেক ইতিহাস, যার উন্মোচন হওয়া দরকার।
সময় যত যাচ্ছে, আমাদের হাতে নতুন নতুন তথ্য আসছে। আমরা অনেক কিছু জানতে পারছি, যা পাঁচ-দশ বছর আগেও জানতাম না। ভারত ও পাকিস্তান সরকার তাদের সব গোপন নথি অবমুক্ত করে দিলে অনেক লুকানো বা হারানো ইতিহাস পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসবে। তারা ইতিমধ্যে অনেক কিছুই প্রকাশ করেছে। আবার নষ্ট করে দিয়েছে অনেক কিছু।
স্বাধীন ইতিহাসচর্চাকে কোনো সরকারই ভালো চোখে দেখে না। এখানে গোপনীয়তা হলো সরকারের ক্ষমতার অন্যতম উৎস। কখনো-সখনো সরকার নিজেই মার্সেনারি লেখকদের দিয়ে মনগড়া ইতিহাস লেখায়। এসব বেশি দিন টেকে না। সরকার বদলে গেলে ইতিহাসও পাল্টে যায়। নতুন সরকার এসে আগের সরকারের খারাপ কাজগুলোর অনুকরণ করে। অপেক্ষাকৃত মুক্ত সমাজে এসব উৎপাত নেই বা থাকলেও কম।
গত দশ বছরে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে একাত্তর নিয়ে অনেক ভালো কাজ হতে দেখেছি। সত্তর বা আশির দশকে যাঁরা একাত্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা অনেকেই অনেক তথ্যের খোঁজ পাননি, যার নাগাল আমরা এখন পাচ্ছি। এভাবেই একদিন লেখা হবে বাংলাদেশের প্রামাণ্য ইতিহাস। একটি-দুটি বই ছাপিয়ে বলে দেওয়া যাবে না যে এটাই ইতিহাস। কোনো ব্যক্তির পক্ষেই একা একা সবটা জানাবোঝা সম্ভব নয়।
সবার শেষে একটা মন্তব্য করব। ইতিহাসচর্চা প্যাশনের ব্যাপার। এ জন্য লেগে থাকতে হয়। বাধাবিপত্তি ও চোখরাঙানি উপেক্ষা করে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হয়। প্রকল্প বানিয়ে ইতিহাসচর্চা হয় না। এটা রাজকবিদেরও কাজ নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ: গবেষক ও লেখক।