সিইও পথে পথে-১
‘দয়াল’ হতে চান পঞ্চগড়ের বলরামপুরের তরুণ-তরুণীরা
‘পথে পথে’ গ্রামীণফোনের একটি বিশেষ উদ্যোগ, যার অংশ হিসেবে দেশব্যাপী গ্রাহক, মাঠপর্যায়ের কর্মী, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান। পঞ্চগড়ের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দেখা হয় খেতে কাজ করা এক তরুণের সঙ্গে। তারপর কী কথা হয় দুজনের মধ্যে? জানা যাক সেই গল্প।
কখনো পাওয়ার টিলার চালাচ্ছেন, কখনো ফসল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। আর অনর্গল কথা বলছেন ইংরেজিতে। উচ্চারণও এত চমৎকার, শুনে চমকে যাবেন যে কেউ। এ প্রতিভার কারণেই ইন্টারনেটের কল্যাণে এই তরুণের ভিডিও দেখেন লাখো মানুষ।
সত্যিকার অর্থেই এখন পঞ্চগড়ের বলরামপুর গ্রামসহ দেশের নানা বয়সী মানুষের ইংরেজি শেখার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছেন এই তরুণ। ফেসবুকে তাঁর অনুসারীর (ফলোয়ার) সংখ্যা ৬ লাখ ২৭ হাজারের বেশি, আর ইউটিউবে ২ লাখ ১৪ হাজার। নিজের সংগ্রামী জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন তাঁর ভ্লগে। খেতে কাজ করতে করতেই ভিডিও তৈরি করেন, ফসলের মাঠ হয়ে যায় তাঁর ‘স্টুডিও’। আত্মবিশ্বাসী এই তরুণের নাম দয়াল চন্দ্র বর্মন।
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান ‘পথে পথে’ ঘুরতে বের হয়েছেন গত ৫ মে। শুরু করেছেন পঞ্চগড় থেকে। দেখা করেন দয়ালের সঙ্গে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁরই সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন জেনে চমকে উঠেছেন দয়াল। ইংরেজিতেই আমন্ত্রণ জানান ইয়াসির আজমানকে, বলেন, ‘আমি খুশি হয়েছি আপনি আমাদের গ্রামে এসেছেন দেখে।’
বলরামপুর গ্রামের সবাই মুগ্ধ দয়ালের এমন প্রতিভা দেখে। তাঁদের মতে, অনেক মানুষ আমেরিকায় থেকেও শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে পারে না অথচ দয়াল খেতে কাজ করেই অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছেন। তাঁকে দেখে গ্রামের অনেকেই এখন ভিডিও বানাচ্ছে।
কিন্তু দয়াল এ ব্যাপারে কী বলছেন?
‘সবাই আগে মনে করত ইন্টারনেটে শুধু নাচ-গান শেখা যায়। এ ধরনের ভিডিওতেই ভিউজ পাওয়া যায়। কিন্তু এখান থেকে যে ইংরেজিও শেখা যায়, তা দেখে সবাই অবাক। আমার “৪ ইঞ্চি স্কুলে”র মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই আমার কাছে ইংরেজি শিখছেন। এমনকি বলরামপুরের কাক-পক্ষীও যেন ইংরেজিতেই ডাকাডাকি করছে!’ মুচকি হেসে বলেন দয়াল।
দয়ালকে নিয়ে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান বলেন, ‘ছোটবেলায় কেউ কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আবার আমার মতো ট্রেনের ড্রাইভারও হতে চেয়েছেন। কিন্তু পঞ্চগড়ের এ গ্রামের মানুষ দেখছি ‘‘দয়াল’’ হতে চান। কে বলেছে স্যুট-টাই পরা মানুষেরাই শুধু ইংরেজি বলতে পারেন? ইচ্ছা থাকলে ফসল বুনতে বুনতেও ইংরেজি বলা যায়। সত্যি, দয়ালের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। দয়াল শুধু ভালো ইংরেজিই বলে না, সে বড় ধরনের দার্শনিকও। তাঁর চিন্তাভাবনা বরাবরই উন্নত ও সংগঠিত।’
ছেলে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা বড় চাকরিজীবী হোক—সন্তানকে নিয়ে এমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না দয়ালের বাবা পুলিন চন্দ্র বর্মনের। চাওয়াটা ছিল খুব সরল, যেন ইংরেজিতে সুন্দর করে কথা বলতে পারে। দয়ালকে সঙ্গে নিয়ে ফসল বুনতে বুনতেই এক ফাঁকে স্বপ্নটাও বুনে দিয়েছিলেন মনে, ইংরেজি শিখতে হবে। বন্ধুরা যখন প্রাইভেট পড়ায় ব্যস্ত, দয়াল তখন ব্যস্ত ছিলেন ইংরেজির ভিতটাকে আরও মজবুত করার কাজে। পঞ্চগড় বিষ্ণুপ্রসাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তেন তখন। কিন্তু পাশের গ্রামের প্রামাণিক পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজগর আলীর ইংরেজি পড়ানোটা তাঁর ভালো লাগত। সেই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানেই চলত দয়ালের ইংরেজির চর্চা।
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার বাসিন্দা দয়াল কখনো নামী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি। এমনকি কলেজে উঠে পড়ালেখা ছেড়েই দিয়েছিলেন। পরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। কিন্তু নিজের ইংরেজির ভিতটাকে মজবুত করতে ইন্টারনেটে খুঁজেছেন অনেক উপায়। পেয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। অদম্য ইচ্ছা আর আগ্রহ থাকলে যে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ দয়াল চন্দ্র বর্মন। তাঁর ইংরেজির উচ্চারণ ও বলার সাবলীলতায় সহজেই অনুমেয়, দয়ালের মনে তাঁর বাবার বুনে দেওয়া ইংরেজির ফসলটা ভালোই ফলন দিচ্ছে। লাভবান করছে আশপাশের ইংরেজির ভীতিতে শঙ্কিত হওয়া অনেককে। ইংরেজি বলার দক্ষতায় দয়াল বিভিন্ন সময়ে জিতেছেন জাতীয় পর্যায়ের অনেক পুরস্কার, সম্পৃক্ত হয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন অনলাইনভিত্তিক অনেক ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবকে।
দয়ালের সঙ্গে দেখা করে ও আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ঘুরে দেখেন প্রকৃতির সবুজ চাদরে মোড়ানো বলরামপুর গ্রাম। পথে পথের এ পর্বের উপসংহার টানতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকাল যেভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৈরি হচ্ছে, আমার মনে হয় আমাদের নেটওয়ার্ক ক্যাপাসিটি আরও বাড়াতে হবে। আমরা সব সময়ই গ্রাহকের পরিবর্তনশীল চাহিদা অনুযায়ী তাঁদের সেরা অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে চাই। তাই গ্রাহকের কাছাকাছি এসে তাঁদের বৈচিত্র্যময় চাহিদার কথা জেনে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অংশ নিতে চায় গ্রামীণফোন।’