অ্যাসিড–সন্ত্রাস একসময় দেশের আলোচিত একটি সমস্যা ছিল। সামাজিক সংগঠন, গণমাধ্যম ও সরকারের উদ্যোগে সেই সমস্যা অনেকটাই কমে আসে। সম্প্রতি অ্যাসিড–সন্ত্রাস আবার বেড়েছে। এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে আগের মতো প্রচার–প্রচারণা নেই। সরকারি পর্যায়ে সেভাবে তদারকিও হয় না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ১৯ আগস্ট শনিবার ‘অ্যাসিডবিরোধী সংলাপ: অ্যাসিড–সন্ত্রাস নির্মূলে করণীয়’ শীর্ষক সংলাপে এসব কথা উঠে এসেছে। প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে এ সংলাপের আয়োজন করা হয়।
সংলাপের শুরুতে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক অ্যাসিডদগ্ধের ঘটনার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি জানান, ২০০২ সালে অ্যাসিডদগ্ধের সংখ্যা ছিল ৪৯৬, যা পরে সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং সরকারের আইন প্রণয়নের ফলে অনেকটাই কমে যায়। ২০১৮ সালে অ্যাসিডদগ্ধের সংখ্যা ছিল ২২। ২০২২ সালে তা ২৯ হয়। অর্থাৎ অ্যাসিড–সন্ত্রাস আবার বাড়ছে।
গত শতকের আশির দশক থেকে অ্যাসিডদগ্ধ মানুষদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা জানান রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, আগে এসব ভুক্তভোগীর পাশে মা ছাড়া কেউ থাকতেন না। এখন অনেককে পাওয়া যায়। আর যত চিকিৎসাই হোক না কেন, একজন অ্যাসিডদগ্ধ মানুষকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব না। তাই এটি প্রতিরোধ করতে হবে। অ্যাসিডদগ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে এ অপরাধ কমানো যাবে না।
প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা এক উপস্থাপনায় অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মামলার চিত্র তুলে ধরেন। অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের বরাতে তিনি বলেন, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৩৭ জন অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন। ২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ১৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১ হাজার ৯৫০ জন খালাস পেয়েছেন। গত ১৯ বছরে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। তবে একটিও কার্যকর হয়নি। তিনি আরও জানান, প্রথম আলো ট্রাস্ট প্রায় ৪৫০ জন অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে সহায়তা দিয়েছে।
মামলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আমেনা বেগম বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গেলে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তদারকির জন্য যে বৈঠক হওয়া দরকার, সেগুলো অনেক দিন হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অ্যাসিড–সন্ত্রাসের ছয়টি মামলা হয়েছে।
শুধু নারীই নন, এখন পুরুষ ও শিশুরাও অ্যাসিড–সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। যাঁরা এমন সহিংস আচরণ করছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করা এবং তাঁদের সচেতন করার কথা জানান মনোরোগবিশেষজ্ঞ এম এ মোহিত কামাল। তিনি বলেন, সচেতনতার জন্য মানুষের মুঠোফোনে অ্যাসিড–সন্ত্রাসবিরোধী বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আগের মতো জোরদার কার্যক্রম না থাকার কথা উঠে আসে অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সরদার জাহাঙ্গীর হোসেনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, গত তিন বছরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ–সংক্রান্ত কোনো বৈঠক হয়েছে বলে তাঁর জানা নেই। এ ছাড়া জেলা পর্যায়ে প্রশাসনের উদ্যোগে যে কমিটি আছে, সেটিরও বৈঠক এখন হয় না। অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিষয়গুলোর তদারকি হয় না।
সংলাপে প্রথম আলো ট্রাস্টের ট্রাস্টি জাহিদা ইস্পাহানী বলেন, নিজ নিজ জায়গা থেকে সবার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ভুক্তভোগীদের শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক প্রয়োজন, মানসিক শক্তির মতো বিষয়গুলোতে সহযোগিতা করতে হবে। বাসা থেকেই অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আবার জোরালোভাবে সোচ্চার হওয়ার জন্য প্রথম আলোর সব মাধ্যমে প্রচারণা চালানোর কথা জানান প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ব্র্যাক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন এবং প্রথম আলো ট্রাস্টের অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। এ–সংক্রান্ত আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলা পর্যায়ে তদারকির দাবি তুলতে হবে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছেও বিষয়গুলো উত্থাপন করতে হবে।
আনিসুল হকের সঞ্চালনায় সংলাপে আরও বক্তব্য দেন আনিসুল হকের সঞ্চালনায় সংলাপে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. বিধান সরকার, সহকারী রেজিস্ট্রার আশিকুর রহমান, দুর্যোগ ফোরামের আহ্বায়ক গওহার নঈম ওয়ারা, ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার জয়শ্রী সরকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সেলিনা আক্তার, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের ডেটা অ্যান্ট্রি অপারেটর রেক্সোনা ইসলাম এবং প্রথম আলো ট্রাস্টের অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের সহায়ক তহবিলের সহায়তাপ্রাপ্ত ও ব্যাংকার মনিকা হালদার।