ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য খুঁজে বের করেন দীপ্ত
ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়েব পোর্টালসহ প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে বাঙালিদের কীভাবে তুলে ধরা হয়, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল মুন্সিগঞ্জের ছেলে দীপ্ত দাসের। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে এই আগ্রহ থেকেই শুরু করেন গবেষণা।
গবেষণার স্বীকৃতিও পেয়েছেন দীপ্ত। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মডারেশনের মাধ্যমে কীভাবে ভাষারীতির ভিত্তিতে বৈষম্য তৈরি হয় এবং কীভাবে তা বাঙালিদের মধ্যে ধর্ম ও জাতীয়তার ভিত্তিতে বিভেদ তৈরি করে, এটা নিয়ে গবেষণা করেন দীপ্ত। ২০২১ সালে সোশ্যাল কম্পিউটিংয়ের কনফারেন্সে (এসিএম কনফারেন্স অন কম্পিউটার-সাপোর্টেড কো-অপারেটিভ ওয়ার্ক অ্যান্ড সোশ্যাল কম্পিউটিং) ‘বেস্ট পেপার অনারেবল’ মেনশন পায় তাঁর গবেষণা। ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইনক্লুশনে (বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি) অবদান রাখার জন্য তাঁর কাজের ভূমিকাকে স্বীকৃতি জানানো হয়।
দীপ্ত বলেন, নারী-পুরুষ, ভাই-বোন এমন শব্দে ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়, অর্থাৎ ইতিবাচক শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করে। হিন্দু-মুসলমান শব্দের ক্ষেত্রে ৩৮ শতাংশ পক্ষপাতিত্ব ছিল মুসলিম শব্দের প্রতি। বাংলাদেশি-ভারতীয় শব্দের বেলায় ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ছিল বাংলাদেশিদের প্রতি।
গবেষণার ফলাফল একাধিকবার হিউম্যান-কম্পিউটার ইন্টারঅ্যাকশনের সবচেয়ে সম্মানজনক ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত এসিএম সিএইচআইতে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো অ্যাট বোল্ডার থেকে গবেষণার জন্য বেশ কয়েকটি বৃত্তি এবং অনুদান পেয়েছেন দীপ্ত।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো অ্যাট বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন সায়েন্সে পিএইচডি সম্পন্ন হবে দীপ্তর। তিনি গত বছর (২০২৩ সাল) একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইনফরমেশন সায়েন্সে দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর করেন।
দীপ্ত মুন্সিগঞ্জের ছেলে। তবে বড় হয়েছেন নারায়ণগঞ্জে। বাবা মারা গেছেন ২০১৩ সালে। দেশে মা আর ছোট বোন আছেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে কথা হয় দীপ্তর সঙ্গে।
দীপ্তর গবেষণার ক্ষেত্র মূলত হিউম্যান-কম্পিউটার ইন্টারঅ্যাকশন নিয়ে। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সেগুলো পরিচালনাকারী মডারেটর এবং অ্যালগরিদম (যেকোনো কাজ করার জন্য কম্পিউটারকে ধাপে ধাপে দেওয়া নির্দেশনা) কীভাবে ভাষা, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতীয়তাভিত্তিক পরিচয় প্রকাশে ভূমিকা রাখে, তিনি সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। গবেষণায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যালগরিদম কীভাবে বিভিন্ন বাংলা রীতি (প্রমিত-আঞ্চলিক), নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, বাঙাল-ঘটি এদের মধ্যে বৈষম্য করে, তা খুঁজে বের করেছেন।
দীপ্ত বলেন, এই টুলগুলো কারা তৈরি করছেন, তাঁদের সঙ্গে এই বৈষম্যের সম্পর্ক কী এবং কীভাবে ঔপনিবেশিক বিভাজন এখন কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলা এবং বাঙালিদের প্রভাবিত করছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন গবেষণায়।
কোন শব্দে কেমন পক্ষপাতিত্ব
গবেষণার বিষয়বস্তু সহজভাবে বুঝতে চাইলে দীপ্ত বলেন, বাংলাভাষীদের জন্য বাংলায় একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে কিউইউওআরএ বা কোরা। এই প্ল্যাটফর্ম ভারতীয় বাঙালিদের পাশাপাশি বাংলাদেশের অনেকে ব্যবহার করছেন। কোরার ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে এখানে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে। তার উত্তরও দেওয়া হয়।
গবেষণার কথা উল্লেখ করে দীপ্ত বলেন, কোরা প্ল্যাটফর্মে একটি প্রশ্ন ছিল পানি নিয়ে। তবে প্রশ্নের উত্তরে পানি শব্দটি বাদ দিয়ে জল বলা হয়। অর্থাৎ এখানে আধিপত্য বিস্তার করা হলো। একইভাবে এখানে ভারতের প্রমিত বাংলা চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়।
দীপ্ত বলেন, কোরা প্ল্যাটফর্মে কাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও অভিযোগ ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মডারেটর কে, তা জানা গেলেও কোরার মডারেটর কে, তা জানার উপায় নেই। এই কাজটি মানুষ না এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) করছে, তা-ও জানতে চায় মানুষ। এআই যদি মডারেটর হয়, তাহলে বৈষম্যের বিষয়গুলো কীভাবে সামনে আসছে, তা বোঝার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে ধর্ম, জাতীয়তা—এ ধরনের শব্দ আছে এমন ১ লাখ ২১ হাজার বাক্য বিশ্লেষণ করা হয়। ৩৩টি টুলস নিয়ে কাজ করা হয়। টুলসের মাধ্যমে কোন শব্দ ইতিবাচক আর কোন শব্দ নেতিবাচক, তা-ও দেখার চেষ্টা করা হয়।
দীপ্ত বলেন, নারী-পুরুষ, ভাই-বোন এমন শব্দে ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়, অর্থাৎ ইতিবাচক শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করে। হিন্দু-মুসলমান শব্দের ক্ষেত্রে ৩৮ শতাংশ পক্ষপাতিত্ব ছিল মুসলিম শব্দের প্রতি। বাংলাদেশি-ভারতীয় শব্দের বেলায় ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ছিল বাংলাদেশিদের প্রতি। টুলস কেন পক্ষপাতিত্ব করছে, এগুলো কারা তৈরি করছে, এআই মডারেটর হলে বৈষম্যের কারণ কী, তা-ও দেখা হয়।
গবেষণার প্রভাব কী
দীপ্ত বলেন, এ ধরনের গবেষণা বাঙালিয়ানা সম্পর্কে প্রযুক্তি খাতকে সচেতন করে। তেমনই প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় বাঙালি জাতির কোনো অংশ যেন খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর আর সতর্ক থাকার জন্য কীভাবে প্রযুক্তি তৈরি এবং ব্যবহার করা দরকার, সেই ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়।
দীপ্ত বলেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে বাঙালি জাতিকে অনেক দিন দাবিয়ে রাখার ফলে বাঙালিরা নিজেরাই অনেকটা আত্মপরিচয় থেকে দূরে সরে গেছে। এমন প্রান্তিক শ্রেণির মানুষেরা অনেক সময় প্রযুক্তির সাহায্যে নিজেদের পরিচয় এবং মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু প্রযুক্তি যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য বিশ্বে তৈরি করা হয়, তাই সেই প্রযুক্তিগুলোও অনেক সময় ঔপনিবেশিক ধারণা বহন করে।’
ঔপনিবেশিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত এবং দাবিয়ে রাখা বাঙালি জাতির পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের তৈরি প্রযুক্তিগুলো কতটা সাহায্য করতে পারে অথবা কীভাবে পরিচয় প্রকাশে বাধা দিতে পারে, তা গবেষণায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর দীপ্ত একই বিভাগে কিছুদিন গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৯ সালে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমানে পিএইচডি গবেষণার পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো অ্যাট বোল্ডারে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
গবেষণার প্রতিবন্ধকতা
দীপ্ত বলেন, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অনেক সময়েই বাংলা ভাষায় গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার মতো রিসোর্স সহজে পাওয়া যায় না। আসলে হাতে গোনা গুটিকয়েক ভাষা ছাড়া অনেক ভাষার জন্যই এটা সত্যি, যেগুলোকে গবেষকেরা লো-রিসোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ বলে থাকেন। অনেক বাংলা বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ বা সেগুলো কম্পিউটারকে বোঝানোর মতো টুল সচরাচর পাওয়া যায় না বলে গবেষণার অগ্রগতি অনেক সময়েই ধীরগতিতে হয়। এগুলো সময়-শ্রমসাধ্য আর ব্যয়বহুল।
দীপ্ত বলেন, এআইর ব্যবহার বাড়ছে। ফেসবুকসহ অনলাইনে ছড়িয়ে থাকা ডেটা দিয়ে এআইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়িয়ে থাকে। ফলে বিভেদ বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। এখনই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কোন টুলসগুলো ব্যবহার করতে হবে, তা ঠিক করতে হবে।
দীপ্ত জানালেন, তিনি আরও কিছু বিষয়ে পর্যালোচনা করছেন। দাদি-নানির মুখের গল্প, ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় যে জনগোষ্ঠী এক দেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তর হলো, তাঁদের জীবনের গল্প সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ-ভারত ও পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের ইতিহাস কতটুকু জানতে পারছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে পর্যালোচনা করছেন।
ভালো কাজের সুযোগ পেলে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরতে চান দীপ্ত।