অপতথ্য ছড়ানোর উৎসে থাকে সরকার ক্ষমতা টাকা
অপতথ্য এখন বৈশ্বিক সমস্যা। অপতথ্য ছড়ানোর উৎসে থাকে সরকার, ক্ষমতা ও টাকা। এটা খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সঠিক তথ্যকে প্রভাবিত করে। অপতথ্য এখন একটি ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে উঠেছে। একে মোকাবিলায় মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকার পাশাপাশি নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘ট্রুথ ইন দ্য ক্রস ফায়ার: নেভিগেশন জার্নালিজম ইন দ্য এজ অব ডিজইনফরমেশন’ শীর্ষক আলোচনায় এ কথাগুলো উঠে আসে। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৪’ (বঙ্গোপসাগর সংলাপ) নামে তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়ার–এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন বলেন, ভুল তথ্য ও অপতথ্যের উৎসে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সরকার থাকে। অপতথ্য খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সঠিক তথ্যকে প্রভাবিত করে। তিনি আরও বলেন, ভারতে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল—যারা অপতথ্য ও ভুল তথ্য অনেক ছড়িয়ে থাকে, তারাই কিন্তু আবার এমন আইন–নীতি করছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কঠিন করে তুলছে। এটা শুধু ভারতেই হচ্ছে না, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেও হচ্ছে।
অপতথ্যের উদাহরণ টানতে গিয়ে ভারতীয় এই সাংবাদিক বলেন, ঝাড়খন্ডের নির্বাচন বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝাড়খন্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সীমানা নেই। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যেখানে সরকার কোনো সঠিক তথ্য ছাড়াই অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা প্রচার করে যাচ্ছে। এখানে অপতথ্যকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন আরও বলেন, কোনটা অপতথ্য বা ভুল তথ্য—সেটা ঠিক করার সিদ্ধান্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি বা শেখ হাসিনার মতো কারও ওপর ছাড়া ঠিক হবে না। এটা নাগরিক সমাজ সিদ্ধান্ত নেবে।
দর্শক সারি থেকে সিদ্ধার্থের কাছে প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে। জবাবে তিনি বলেন, ভারতের বৈদেশিক নীতি থেকে উৎসাহিত হয়ে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম ওই ধরনের প্রতিবেদন করেছে। দিল্লিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেন। তাঁরা খুবই হতাশ যে তিনি এখন ক্ষমতায় নেই। এই গণমাধ্যমগুলো শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই না, ভারতেও একই ধরনের কাজ করে আসছে। কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে বড় বড় ঘটনাগুলো ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, সরকারের প্রোপাগান্ডা প্রচার করেছে।
অপতথ্য এখন একটা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে বলে জানান তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, যাঁদের ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, তাঁরাই মূলত একটা বয়ান তৈরির মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন অপতথ্য ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে। এ জন্য দেখা যায়, নির্বাচনের সময়, রাজনৈতিক কোনো অস্থিরতা, ধর্মীয় কোনো ইস্যুতে এ ধরনের অপতথ্যের পরিমাণ বেড়ে যায়।
মিরাজ আহমেদ আরও বলেন, এখন অপতথ্য ছড়ানোর জন্য অর্থ বিনিয়োগ করা, সংস্থা ভাড়া করা হয়। এমনকি প্ল্যাটফর্মগুলোও অনেক সময় এগুলো শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। কারা এসব অর্থ বিনিয়োগ করছে, এসব রোধে প্ল্যাটফর্মগুলোর ভূমিকা কী, রাজনীতিবিদেরা কীভাবে এটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে মানুষকে প্রভাবিত করছে, তা দেখতে হবে।
অপতথ্য ও ভুল তথ্যকে এখন সারা বিশ্বের সমস্যা উল্লেখ করে ক্যান্ডিড ফাউন্ডেশনের পরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরেশিয়া) ও জেনিথ ম্যাগাজিনের সম্পাদক লিও উইগার বলেন, মানুষ প্রথাগত গণমাধ্যমের ওপর দিন দিন আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং এখানে ইনফ্লুয়েন্সাররা জায়গা করে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, অপতথ্য ঘুরে বেড়াতে থাকলে একটা সময় মানুষ ভাবতে শুরু করে এর মধ্যে হয়তো কিছু ঘটেছে। অপতথ্যকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তা পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।
লিও উইগার আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সাংবাদিকতা এখন অ্যালার্মিং হয়ে উঠেছে। কারণ এর উৎস, সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। এটা সঠিক কি না, তা বুঝতে পারার জন্য সেই পরিমাণে মিডিয়া লিটারেসি (গণমাধ্যম বিষয়ে বোঝাপড়া) প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনজীবী রাজু মহাজন সাংবাদিকতার জন্য নিবন্ধনপদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন বলে মত দেন। তিনি বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, নিবন্ধন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সাংবাদিক হতে হবে। তারা কোনো নির্দিষ্ট গাইডলাইনের বাইরে যাবে না। এটা নিশ্চিত করা গেলে সাংবাদিকতার অপব্যবহার বন্ধ হবে এবং অপতথ্য বন্ধ হবে।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের সিনিয়র গভর্ন্যান্স স্পেশালিস্ট শিলা তাসনিম হক বলেন, অপতথ্য রোধে নাগরিক সমাজ ও প্ল্যাটফর্মগুলোকে একসঙ্গে ভূমিকা রাখতে হবে। অপতথ্য সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তাই এটা রোধে আন্তসম্পর্কিত দেশগুলোকেও একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইতালিভিত্তিক ডিজাল কনসাল্টিংয়ের কর্মকর্তা লরা লরাচ্চিয়া।