৭৮ লাখ বই নষ্ট, অপচয় অন্তত ২৩ কোটি টাকা
ভুল ও অসংগতি নিয়ে বিতর্কের মুখে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বইয়ের পাঠদান প্রত্যাহারের কারণে ৭৮ লাখের বেশি বই নষ্ট হচ্ছে। আর এ কারণে সরকারের অপচয় হচ্ছে অন্তত ২৩ কোটি টাকা। নতুন শিক্ষাক্রমের কয়েকটি বই নিয়ে বিতর্কের মুখে ১০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি দিনে আকস্মিকভাবে এ বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এখন জানা যাচ্ছে, মোট বইয়ের সংখ্যা ও খরচের তথ্য। বইগুলো যেহেতু পড়ানো হবে না এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে, সে জন্য এগুলোকে নষ্ট বলা হচ্ছে।
অন্যদিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের কিছু অধ্যায় সংশোধনের কাজ চলছে। যেসব বিষয় সংশোধন হচ্ছে তার কিছু কিছু বিষয় ঠিকও করা হয়েছে। তবে প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল শিগগিরই সংশোধনীগুলো চূড়ান্ত করে তা শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু সর্বশেষ তথ্য হলো, এই সংশোধনী দিতে আরেকটু সময় লাগবে। এ বিষয়ে আজ রোববার এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, পাঠ্যবইয়ের ভুল-অসংগতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি কাজ করছে। তাই এখন পরিকল্পনা হলো ওই কমিটির প্রতিবেদন এবং সেই সঙ্গে আগামী মার্চে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, তার ওপর ভিত্তি করে সংশোধনী দেওয়া হবে। ফলে সংশোধনী দিতে মাসখানেক সময় লেগে যেতে পারে।
বই ছাপার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দুই শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের সবই ছাপা হয়েছিল। তার মানে এই বিপুল পরিমাণ বই এখন নষ্ট হলো। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তার মতে, একেকটি বই ছাপতে গড়ে খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৩ টাকা। যদি একেকটি বই সর্বনিম্ন ৩০ টাকাও ধরা হয়, তাহলে মোট অপচয় দাঁড়ায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকার বেশি। অবশ্য এনসিটিবির আরেকজন কর্মকর্তার ধারণা, এসব বই ছাপাতে খরচ হয়েছে আরও বেশি।
গত ১ জানুয়ারি প্রথম, ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নব্যবস্থা, পড়ানোর ধরন এবং বইগুলো পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এত বড় পরিবর্তন হলেও বাস্তবায়নের কাজটিতে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতিতে যেমন হেলাফেলা ছিল, তেমনি বইগুলোও তাড়াহুড়ো করে বের করতে গিয়ে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি ও অসংগতি রয়ে গেছে। এ নিয়ে বিতর্কের মুখেই দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম কয়েক দিন আগে প্রথম আলোকে বলেন, এই দুটি বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে উপজেলায় নিয়ে আসার জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। বইগুলো তুলে আনার পর কী করা হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে, যে বই দুটি (ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই) প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মোট সংখ্যা ৭৮ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা সংস্করণে (ভার্সন) এই বইয়ের সংখ্যা ৩২ লাখ ৮২ হাজারের বেশি। আর সপ্তম শ্রেণির বাংলা সংস্করণে এই বইয়ের সংখ্যা ৩০ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। অন্যদিকে মাদ্রাসার (দাখিল মাদ্রাসা) ষষ্ঠ শ্রেণিতে বইটির সংখ্যা ৭ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি। আর মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণিতে এই বই ৭ লাখ ৭ হাজারের বেশি। এ ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি সংস্করণে এই বইয়ের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি এবং সপ্তম শ্রেণিতে ইংরেজি সংস্করণে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের সংখ্যা ২৪ হাজারের বেশি।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের নাম একই।
নতুন শিক্ষাক্রমের বই প্রত্যাহার ও সংশোধনীর বাইরে এর আগে চলতি শিক্ষাবর্ষের পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি মাধ্যমিক স্তরের তিনটি বইয়ে ৯টি ভুলভ্রান্তির সত্যতা পেয়ে এক পাতায় সংশোধনী দিয়েছিল এনসিটিবি।
বই ছাপার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দুই শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের সবই ছাপা হয়েছিল। তার মানে এই বিপুল পরিমাণ বই এখন নষ্ট হলো। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তার মতে, একেকটি বই ছাপতে গড়ে খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৩ টাকা। যদি একেকটি বই সর্বনিম্ন ৩০ টাকাও ধরা হয়, তাহলে মোট অপচয় দাঁড়ায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকার বেশি। অবশ্য এনসিটিবির আরেকজন কর্মকর্তার ধারণা, এসব বই ছাপাতে খরচ হয়েছে আরও বেশি।
তবে এনসিটিবি কর্মকর্তারা বইয়ের সংখ্যা এবং খরচের প্রকৃত তথ্য দিতে চাইছেন না। একেক কর্মকর্তা একেক ধরনের কথা বলছেন।
তিন বইয়ে যেসব সংশোধনী হতে পারে
ওই দুটি বই প্রত্যাহারের পাশাপাশি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের কিছু অধ্যায় সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। ইতিমধ্যে সেই সংশোধনীর কাজও চলছে।
কী রকমের সংশোধনী আনা হচ্ছে, জানতে চাইলে এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিতর্কিত বিষয়গুলোই মূলত সংশোধন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্যগত ভুলগুলোও সংশোধন করা হবে। যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, অনুশীলন বই’-এ ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজিকে নিয়ে লেখা অংশে কিছু পরিবর্তন করা হবে। সেখানে এখন বইয়ে যেমন ‘দখল’ আছে, সেটি পরিবর্তন করে ‘বিজয়’ করা হতে পারে। ওই অংশে এ রকম আরও কিছু সংশোধন করা হতে পারে। অন্যদিকে ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের মানব শরীর নামের অধ্যায়ে বয়ঃসন্ধি অংশে কিছু পরিবর্তন করা হবে।
এনসিটিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, বইয়ে বয়ঃসন্ধি বিষয়টি থাকবে, কিন্তু সেই লেখায় পরিবর্তন আসবে। এখনকার বইয়ে থাকা বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন হবে। এ রকমভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়ানোর চেষ্টা করা হবে।
সংশোধনীগুলো কীভাবে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে, জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংশোধনীর পরিমাণ অনুযায়ী দেওয়ার পদ্ধতি ঠিক হবে। যদি এক পাতার মধ্যে হয় তাহলে একভাবে দেওয়া হবে, আর যদি সংশোধনীর পরিমাণ একটু বেশি হয়, তাহলে ‘ডিউ পার্ট (অংশবিশেষ ছাপিয়ে দেওয়া)’ হিসেবে দেওয়া হবে। এটি নির্ভর করছে সংশোধনীর পরিমাণের ওপর।
নতুন শিক্ষাক্রমের বই প্রত্যাহার ও সংশোধনীর বাইরে এর আগে চলতি শিক্ষাবর্ষের পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি মাধ্যমিক স্তরের তিনটি বইয়ে ৯টি ভুলভ্রান্তির সত্যতা পেয়ে এক পাতায় সংশোধনী দিয়েছিল এনসিটিবি।