কারাগারে মা–মেয়েকে ব্যথানাশক ওষুধ কিনে দিয়ে এলেন স্বজনেরা

কারাগার
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক নারী সার্জেন্টের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তির ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দী মা ও মেয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করছেন। মারধরে দুজনের শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মা দিলারা আক্তার ও মেয়ে তাসফিয়া ইসলামের সঙ্গে দেখা করে স্বজনেরা এসব কথা জানিয়েছেন।

দিলারা আক্তারের স্বামী মফিজুল ইসলাম রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের রাজধানীর তোপখানা রোড করপোরেট শাখার উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম)। তিনি বড় মেয়ে তানজিলা ইসলামকে নিয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন স্ত্রী ও মেজ মেয়ে তাসফিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। কারাবন্দী তাসফিয়া ধানমন্ডিতে বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য প্রকৌশলে স্নাতক শেষ বর্ষে পড়েন। আর তানজিলা এমবিবিএস পাস করে এখন এফসিপিএস করছেন।

কারাগার থেকে বেরিয়ে মফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে দেখা করতে গেলে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাঁদের ওপর পুলিশের করা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। আর তানজিলা বলেন, তাসফিয়া তাঁকে দেখিয়েছেন পুলিশের মারধরে তাঁর (তাসফিয়া) ডান হাত এবং আঙুলের কয়েক জায়গায় কেটে ও ছিঁড়ে গেছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারধরের চিহ্নও দেখিয়েছেন।

ট্রাফিক সার্জেন্ট হাসিনা খাতুন তাঁর ‘চুলের মুঠি ধরে টানাহেঁচড়া করায়’ তাসফিয়ার মাথার দুই পাশ ফুলে উঠেছে, সেই চিহ্নও বোন তাঁকে দেখিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তানজিলা। তিনি বলেন, তাসফিয়া ব্যথায় সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। কারাগারে চিকিৎসাও পাননি। তাঁর মা-ও বলেছেন যে পুলিশ তাঁকেও মারধর করেছে।

মা ও বোনকে ব্যথানাশক ওষুধ কিনে দিয়ে এসেছেন বলে জানান চিকিৎসক তানজিলা ইসলাম। কারাগারে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে সেখান থেকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য তাসফিয়াকে পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় একটি প্রাইভেট কার অবৈধভাবে পার্কিংয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট হাসিনা খাতুন। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওই সার্জেন্টের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান দিলারা আক্তার ও তাঁর মেয়ে তাসফিয়া। একপর্যায়ে দুই পক্ষে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় সার্জেন্ট হাসিনার করা মামলায় গতকাল বুধবার মা–মেয়েকে কারাগারে পাঠানো হয়।

আরও পড়ুন

ঘটনার বিষয়ে পুলিশ বলছে, জরিমানার বিষয়টি জানতে পেরে দিলারা আক্তার বাসা থেকে এসে সার্জেন্ট হাসিনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। একপর্যায়ে তাঁর গায়ে হাত তোলেন। পরে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলে তাঁদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেন দিলারা। তখন থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা গিয়ে দিলারা আক্তার ও তাঁর মেয়েকে আটক করেন। পরে সার্জেন্ট হাসিনা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় দিলারা আক্তার ও তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা, সরকারি লোককে মারপিট করা এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।

অপর দিকে তাসফিয়ার বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, ওই দিন সন্ধ্যায় মেয়ে তাসফিয়া শরীরচর্চার জন্য শিয়া মসজিদ এলাকার একটি ব্যায়ামাগারে গিয়েছিলেন। চালক গাড়ির গতি কমিয়ে তাঁকে নামিয়ে চলে আসছিলেন। এর মধ্যে সার্জেন্ট হাসিনা খাতুন গাড়ি থামিয়ে পাঁচ হাজার টাকার মামলা দেন। তখন চালক মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের বাসায় গিয়ে জানালে তাঁর স্ত্রী (দিলারা) বিষয়টি সম্পর্কে জানতে সেখানে যান। পরে তাসফিয়াও ব্যায়ামাগার থেকে নেমে এসে জানতে চান, কেন মামলা দেওয়া হলো। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে সার্জেন্ট হাসিনা আমার মেয়েকে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের মধ্যে নিয়ে মারধর করেন। এটা দেখে আমার স্ত্রী দিলারা এগিয়ে গেলে তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়।’

তাসফিয়ার বড় বোন তানজিলা প্রথম আলোকে বলেন, খবর পেয়ে তিনি শিয়া মসজিদ এলাকায় গিয়ে দেখেন তাসফিয়া ও তাঁর মাকে শিয়া মসজিদ ট্রাফিক বক্সের ভেতর আটকে রাখা হয়েছে। তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

আজ কারাগারে তাসফিয়া তাঁদের ওপর পুলিশের হামলা ও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন জানিয়ে তানজিলা বলেন, ‘ট্রাফিক বক্সে আটকে রেখে মারধর করার পর পোশাক পরা এক পুলিশ সদস্য তাঁর (তাসফিয়া) মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলেন, “গুলি করে মেরে ফেলব।” পুলিশের পোশাক পরা নেই, এমন কয়েকজন যুবক তাঁদের অকথ্য গালাগাল করেন।’

তানজিলা জানান, সাদাপোশাকের দুই যুবক পুলিশ বক্স থেকে থেকে তাসফিয়ার ডান হাত মুচড়ে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি এর প্রতিবাদ করলে তাঁরা সরে যান। পরে তিনি নিজে তাসফিয়াকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন।

তাসফিয়ার বাবা মফিজুল আজ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের আচরণে তিনি হতাশ। এ ঘটনায় এক দিনের ব্যবধানে তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। স্ত্রী–মেয়েকে প্রথমে থানা হেফাজতে, পরে  কারাগারে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশ যেভাবে তাঁর মেয়ে ও স্ত্রীকে মারধর করেছে, তাতে তাদের বিরুদ্ধে তাঁরই মামলা করার কথা। বিষয়টি মীমাংসা করতে তিনি থানায় বসে পুলিশের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। প্রয়োজনে মেয়ে ও স্ত্রীর কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়ারও অনুরোধ করেন। কিন্তু পুলিশ তাঁর অনুরোধে পাত্তা দেয়নি। এমনকি তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের কাছ থেকেও সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু শুনতে চাননি। উল্টো যিনি হামলা করেন, সেই ট্রাফিক সার্জেন্ট তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

মফিজুল বলেন, তিনি (মফিজুল) হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। তাঁর স্ত্রী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। স্ত্রী ও মেয়ের দুশ্চিন্তায় সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। এখন স্ত্রী–মেয়েকে নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না।

যা বললেন সার্জেন্ট হাসিনা খাতুন

আজ রাতে যোগাযোগ করা হলে ট্রাফিক সার্জেন্ট হাসিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের অভিযোগে পাঁচ হাজার টাকার মামলা দেওয়ার পর দিলারা আক্তার ছুটে এসে উত্তেজিত হন। এ সময় তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে তাসফিয়া এসেই বলেন, ‘আমার গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দিলি কেন?’ এ নিয়ে কথা–কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাসফিয়া তাঁর মুখমণ্ডলে আঘাত করেন। তখন তাসফিয়ার মা-ও তাঁকে আক্রমণ করেন।

একপর্যায়ে মা ও মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন জানিয়ে হাসিনা খাতুন বলেন, তখন তিনি একাই দুজনকে ধরে পুলিশ বক্সে এনে আটকে রাখেন। সেখানে তিনি বা অন্য কেউ মা ও মেয়েকে মারধর করেননি। এর তথ্য–প্রমাণ তাঁর কাছে আছে। এ ছাড়া তাসফিয়াকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টাও করা হয়নি। কেউ তাসফিয়ার মাথায় রিভলবার ঠেকাননি।

তাসফিয়ার বাবা মফিজুল ইসলাম ক্ষমা চাওয়ার পর মামলা করলেন কেন—সে প্রশ্নের জবাবে সার্জেন্ট হাসিনা বলেন, তিনি সরকারি পোশাকে দায়িত্বরত ছিলেন। তার মধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন। মার খাওয়ার জন্য তিনি চাকরি করতে আসেননি।

নিজের নিরাপত্তার জন্যই তিনি মা–মেয়ের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছেন বলে দাবি করেন এই ট্রাফিক সার্জেন্ট।