মুনীর চৌধুরীর স্বতন্ত্র ছোটগল্পের বই
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী মাত্র ছেচল্লিশ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জে। পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী। ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। আর ফেরেননি তিনি।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব সাহিত্যসমালোচক হিসেবে হলেও অল্প সময়েই সাহিত্যের আরেক শাখা নাট্যসাহিত্যে তাঁর পদার্পণ পড়েছিল গভীরভাবে। সফল নাট্যকার, সুবক্তা, কমিউনিস্ট, আদর্শ শিক্ষক—এসব বিশেষণের ভিড়ে গল্পকার মুনীর চৌধুরী অনেকটাই অনালোকিত। সামগ্রিকভাবে তাঁকে বুঝতে ‘গল্পকার মুনীর চৌধুরী’র সত্তা অন্বেষণ তাই জরুরি।
১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর আইএসসি পড়তে যান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯৪৩ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অনার্সে। এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, অজিতকুমার গুহ, রবি গুহ প্রমুখের সংস্পর্শে এসে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন অচিরে। একই সঙ্গে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চাও। লিখতে শুরু করেন ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ একটি শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের স্বপ্নভূমিতে দাঁড়িয়ে।
১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ মোটাদাগে চার বছর তাঁর ছোটগল্প লেখার সময়। সংখ্যার বিচারে তাঁর লেখা ছোটগল্প হাতে গোনা। গল্পগুলো লেখা তরুণ বয়সে, সাহিত্যজগতে প্রবেশের প্রথম দিকে।
জীবদ্দশায় তাঁর কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে রচনাবলির অংশ হিসেবে এসব গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত একটি তালাকের কাহিনি ও অন্যান্য গল্প বইটি সেই অর্থে মুনীর চৌধুরীর প্রথম স্বতন্ত্র ছোটগল্পের বই।
সাম্যবাদী রাজনৈতিক আদর্শ ও বিভিন্ন বিষয়ে গভীর অধ্যায়ন সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে শুরু করে। সমাজের কুসংস্কার, ধর্মের প্রভাব, শোষকশ্রেণির দমনপীড়ন, মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র ও নর-নারীর হৃদয়ঘটিত প্রেমের মতো বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে তাঁর ছোটগল্পগুলোতে। সমাজের এসব অসংগতিতে আঘাত করতে তিনি অধিকাংশ গল্পে নিয়েছেন তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের আশ্রয়।
‘হালুম’, ‘নগ্ন পা’, ‘ফিডিং বটল’, ‘বাবা ফেকু, ‘ন্যাংটার দেশে’, ‘খড়ম’, ‘একটি তালাকের কাহিনি’, ‘শবে বরাত’ ও ‘মানুষের জন্য’—মোট ৯টি গল্প নিয়ে এই বই। গল্পগুলোর পটভূমি, কাহিনিনির্মাণ, চরিত্রায়ণ, বর্ণনাভঙ্গি ও সংলাপে মুনীর চৌধুরীর শিল্পপ্রতিভা সহজেই চোখে পড়ে।
‘হালুম’ গল্পটি চল্লিশের দশকের নোয়াখালীর গ্রামীণ একান্নবর্তী পরিবারের আঙিনায় নিয়ে যায় আমাদের। এ গল্পে মুনীর চৌধুরী পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কটাক্ষ করেছেন তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের মাধ্যমে। মুখ গুটিবসন্তের গর্তে ভরা, এক চোখ কানা আশরাফ মুন্সীর ভয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকে তার তিন ছেলের বউ। তবে সুযোগ পেলে তারাও শ্বশুরকে বিদ্রূপ করতে ছাড়ে না, আড়ালে-আবডালে ডাকে ‘হালুম’ বলে!
‘একটি তালাকের কাহিনি’ ও ‘মানুষের জন্য’ এ দুটি সমাজসমস্যামূলক গল্প। তালাকের ভয়াবহতা উঠে এসেছে এখানে। গল্প দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন, কাহিনি ভিন্ন কিন্তু পরিণতি এক। যেখানে একটিমাত্র শব্দ ‘তালাক’ উচ্চারণে অত্যন্ত দুর্বিষহ ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে নারীদের জীবন।
এর বিপরীতে ‘নগ্ন পা’ ও ‘ফিডিং বটল’ গল্পে নারীর স্বাধীনতা গুরুত্ব পেয়েছে। ‘নগ্ন পা’ গল্পে রাহেলার স্বাধীন বাসনা ও চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় শাশুড়ির বিরাগ আর স্বামীর সন্দেহের কাছে। শেষ পর্যন্ত বোরকার আবরণে বাহ্যিকভাবে নিজেকে মুড়ে নিতে বাধ্য হলেও তার ভেতরের বাসনা শৃঙ্খলমুক্ত থেকেছে শেষ পর্যন্ত।
‘ফিডিং বটল’ গল্পটি যেন নারীর স্বাধীনতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে। স্ত্রী আবেদার যৌক্তিক ও অনড় অবস্থানের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় সাজ্জাদকে। পরাভূত হয় একগুঁয়ে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। গল্পের শেষাংশে তা উঠে এসেছে অত্যন্ত শ্লেষাত্মকভাবে, ‘সে দেখিল ভাবি দিব্যি আরামের সঙ্গে পা ছড়াইয়া পাশের প্লেট হইতে ছানামাখা একটি একটি ক্রিম ক্র্যাকার তুলিয়া মুখে দিতেছে আর সাজ্জাদ ভাই সমস্ত পুরুষ জাতির কলঙ্ক হইয়া সেই বিস্কুটে মাখন লাগাইতেছে।’
‘ন্যাংটার দেশে’ গল্পে দুর্ভিক্ষপীড়িত, নিরন্ন অসহায় মানুষের মুখোমুখি হই আমরা। আমেনা ও তার মাকে এক কাপড় পরতে হয় ভাগাভাগি করে। ব্যর্থতার দায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমেনার বাপের সামনে পথ খোলা থাকে একটাই—আত্মহনন। ‘খড়ম’ গল্পে শোষণে জর্জরিত অসহায় মানুষের আর্তনাদ ভারী করে তোলে পাঠকের হৃদয়কে।
নর-নারীর হৃদয়ঘটিত প্রেম আর না পাওয়ার দোলাচল নিয়ে হাজির হয় ‘শবে বরাত’ গল্পটি। আর ‘বাবা ফেকু’ গল্প উন্মোচিত করে আমাদের চারপাশের ব্যক্তির শুচিতার বহিরাবরণের ভেতরের পশুপ্রবৃত্তি।
পাঠক নাট্যকার ও সাহিত্যসমালোচক পরিচয়ের বাইরে গল্পকার মুনীর চৌধুরীকে আলাদা করে আবিষ্কার করবেন এই বইয়ে।