ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, কৃষি ও অর্থনীতি সামগ্রিক সংকটে পড়ছে। তাই পানির বিষয়টি কূটনীতির কেন্দ্রে রাখতে হবে। যদিও এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের কতটুকু আগ্রহ রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়বে, বাংলাদেশের রাজনৈতিকভাবে দর-কষাকষির অবস্থান তত দুর্বল হবে।
‘বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টন: অভিজ্ঞতা, আশঙ্কা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক বিশেষ ওয়েবিনারে এ কথা বলেন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞেরা। আজ রোববার সকালে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তার পানিপ্রবাহ বাড়ানো, নদীটির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে নয়াদিল্লি। বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অসন্তোষ প্রকাশ করেন ওয়েবিনারে। কারণ, প্লাবনভূমির বাংলাদেশে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাই বাংলাদেশের জন্য পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া জরুরি।
ওয়েবিনারে বক্তব্য দেন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তাঁর মতে, ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়াবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিকভাবে দর-কষাকষির অবস্থান তত দুর্বল হবে। তিনি বলেন, পানির ব্যাপারে রাজনৈতিক মহল খুব একটা সোচ্চার নয়। তাঁরা (রাজনীতিবিদেরা) ভারতের কাছে কাঁচা মরিচের জন্য আবেদন করেন, পেঁয়াজের জন্য আবেদন করেন, পানির জন্য আবেদন করেন কি?
পানি নিয়ে কাজ করা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতো সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো সেই ‘রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করে’ দিতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন আইনুন নিশাত।
চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরী সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কাজ করতে গিয়ে এমন দেশের (চীন) সহযোগিতা নিতে গেলে ভারত প্রতিক্রিয়া দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন আইনুন নিশাত। তিস্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে মিলে কাজ করার কথা চিন্তা করে। ভারত তখন আপত্তি জানায়। ভারত বলেছিল, তারাই করে দিতে পারে। গতকাল (শনিবার) দেখলাম, তিস্তার ক্ষেত্রে একটা প্রস্তাব দিয়েছে ভারত।
আইনুন নিশাত বলেন, ‘ভারতের প্রস্তাবে (তিস্তা প্রসঙ্গে) আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত। কারণ হচ্ছে, তিস্তার যে অংশ বাংলাদেশে, সেই অংশের পানির ব্যবস্থাপনা ও পানি সংরক্ষণের ব্যাপারে দুই দেশ কারিগরি কথাবার্তা বলবে। দেশে পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া পানি সংরক্ষণের কোনো জায়গায় নেই।’
ওয়েবিনারে সমাপনী বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিসটিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। নদ-নদীর পানি শুকিয়ে ফেলতে পারলে বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে ফেলা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশ অস্তিত্ব-সংকটে পড়ছে।
পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলেও মনে করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ভারতের ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নির্ভরতা রয়েছে। যার কারণে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
ভারত একটি নদীকে আরেকটি নদীর সঙ্গে যুক্ত করে পানি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হবে। ভারতের একটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করতে পারে যে পানি যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাবে? কিন্তু এমন প্রশ্ন বাংলাদেশ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ২০১১ সালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হতে গিয়েও পরে আর হয়নি। তখন বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য সেই চুক্তি হয়নি। কিন্তু ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায়। তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কারণে।
গঙ্গা পানি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পায়নি বলে মন্তব্য করেন আসিফ নজরুল। যৌথ নদী কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২০২৬ সালে গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। সেটি নবায়ন করতে হবে। না থাকার চেয়ে দুর্বল চুক্তি থাকাও ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ওয়েবিনারে একটি গবেষণাপত্র তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ভূতত্ত্ব ও পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে ৪৩ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ।
সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আরও বক্তব্য দেন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল।