আমার আব্বা কবি গোলাম মোস্তফা শিক্ষক মানুষ ছিলেন। বদলির চাকরির কারণে অবিভক্ত বাংলার নানা জায়গায় থেকেছেন তিনি। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে ভাইবোনদের আদর–যত্নে আমি মানুষ হয়েছি। স্বভাবতই আব্বার সঙ্গে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতাম আমরাও।
আব্বার কর্মস্থল তখন কলকাতায়। পার্ক সার্কাসে আমাদের বাসা। আমার বয়স সে সময় কতই আর হবে—পাঁচ কি ছয় বছর। শিশুশ্রেণিতে পড়ি। স্কুলের নামটা স্মৃতির আয়নায় আজও জ্বলজ্বল করছে—শিশু বিদ্যাপীঠ। চৌহদ্দির মধ্যেই বড়দের ব্রতচারী শেখানো হতো। আমরা জানালা খুলে আগ্রহ নিয়ে সেসব দেখতাম। ওই বয়সে পড়াশোনার চেয়ে এসব দেখতেই ভালো লাগত।
এরই মধ্যে রোজা চলে এল। আব্বাসহ পরিবারের অনেকেই রোজা রাখেন, দেখতাম। রোজার মাসে নানা খাবার তৈরি হতো। সেগুলো খেতে আমার খুবই ভালো লাগত। কিন্তু মুশকিল হলো, দিনের বেলায় বুবুরা খাবার খেতে দিত না, লুকিয়ে রাখত। চাইলেই বলত, এখন না আরেকটু পরে। কিন্তু আমার তর সইত না। সুযোগ বুঝে একটা-দুটো খেয়েই ফেলতাম।
রোজা শেষে ঈদ চলে এলে স্কুল থেকে ছুটি মিলত। ঈদের দিন বুবুরা জামাকাপড় পরিয়ে সাজিয়ে দিত। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন সবাই। ঈদ নিয়ে এখনকার মতো এত আতিশয্য ছিল না। আমরা বরং পুরোনো কাপড় পরতেই আনন্দ পেতাম। আরেকটা সুবিধা হতো, এতে কাপড় নষ্ট করে বড়দের বকাবকিরও ভয় থাকত না।
কলকাতায় আমি দুটো ঈদ করেছি। শৈশবের স্মৃতিতে এই ঈদ দুটোই আমার প্রথম দিকের ঈদ। ঈদের দিন কাপড় পরে আব্বার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম। আমার বড় ভাই মোস্তফা আনোয়ার তখন এয়ারফোর্সে চাকরি করেন, সঙ্গে থাকতেন মেজ ভাই। আশপাশের কয়েক বাড়ির ছেলেরাও তাদের বাবাদের সঙ্গে স্টেশনে চলে আসত। সবাই আমার বয়সী। তারপর সবাই মিলে ট্রামে চড়ে পার্ক সার্কাস থেকে যেতাম ধর্মতলায়। প্রথমবার গিয়ে দেখি, গড়ের মাঠে শত শত মানুষ উপস্থিত। এ–পাশ থেকে ও–পাশ মাঠ ভরে গেছে।
এই বিশাল মাঠেই বড়দের সঙ্গে নামাজে দাঁড়াই। যখন সবাই সেজদায় গেল, এদিকে সমবয়সী ছেলেটার সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি মাঠজুড়ে সমুদ্রের ঢেউ খেলে গেছে। তখনকার দিনে পাঞ্জাবির রঙে এত ভিন্নতা ছিল না। মানুষ সাদা রঙের পাঞ্জাবিই বেশি পরতেন। সেই ঢেউ দেখতে কী যে ভালো লাগল! আজও তা স্মৃতিতে অটুট।
প্রতিবারই ঈদের নামাজ শেষ করে কলকাতায় আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন বা আব্বার কোনো বন্ধুর বাসায় যাওয়া হতো। কেউ কেউ সালামি হিসেবে টাকাপয়সা দিতেন। ওতেই আমার আর আনন্দ ধরত না। আবার কারও বাড়িতে গেলে বিস্কুট বা মিষ্টান্ন খেতে দিত। তখনকার দিনেও ঈদের দিন ফিরনি, জিলাপি, রসগোল্লা, কলকাতার জলযোগের দই বাড়িতে পরিবেশন করা হতো।
একবার হলো কি, আব্বার এক বন্ধুর বাসায় গেছি। অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছিলেন তাঁরা। আমি তো বসে আছি খাবারের অপেক্ষায়। একসময় আব্বার বন্ধু গল্প ছেড়ে উঠে গেলেন। তখন আমি আব্বাকে ফিসফিস করে বললাম, ‘আব্বা, এইবার খাবার আসবে।’ আমার কথা শুনে আব্বা হেসেই খুন। আব্বার হাসির রহস্য জেনে সেই আত্মীয়ও হাসলেন। আমি অবশ্য ভাবলেশহীন, লজ্জা পাওয়ার মতো বয়স তখনো হয়নি বলে খাবারের কথাটা সরল মনেই বলে ফেলেছিলাম।
মনোহরপুরে মাহে রমজান
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপায় আমাদের গ্রামটার নাম মনোহরপুর। বাড়ির দুদিকে একদম খোলা। মাইলের পর মাইল সবুজ মাঠ ছিল। বাড়ির পাশে ছিল অনেক আমগাছ। গরমের সময় বাড়িতে গেলে আম পাড়তাম। সবার সঙ্গে দারুণ আনন্দে সময় কাটত। কিন্তু যাওয়া হতো খুবই কম।
আব্বা একবার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলেন রোজার সময়। তিনি বাড়িতে গিয়েই সবাইকে বলে দিলেন, ‘আমি যত দিন আছি, তত দিন আমার সঙ্গে খাবে।’ এটা তাঁর রেওয়াজ। তিনি বাড়িতে গেলে কখনো একা খেতেন না। আশপাশের সবাইকে নিয়ে খাবার খেতে বসতেন, সবার কথা শুনতেন।
বাড়িতে আমাদের একটা বড় কাছারিঘর ছিল। সেখানেই খাবার আয়োজন হতো। দেখা গেল সাহ্রি বা ইফতারের সময় ১৫-২০ জন চলে আসছেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে খেতে বসে যেতাম। এখন যে রকম ইফতারিতে নানা রকম জিনিস হয়, তখন এত কিছু থাকত না। পেঁয়াজুর মতো একটা কিছু থাকত। সেটা খেয়ে ইফতার শুরু করতেন সবাই। এরপর তরিতরকারি দিয়ে ভাত খেতেন। খাবারের আয়োজন সামান্য হলেও এই যে একসঙ্গে সবাই খেতে বসতেন, সবার পাতে খাবার তুলে দেওয়া হতো, এই যে একতা, মিলেমিশে থাকার প্রবণতা—এর ছাপ আমাদের পরবর্তী জীবনে অনুভব করেছি।
লেখক: চিত্রশিল্পী