প্রচণ্ড গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধ রাখার বিষয়ে একেক সময় একেক রকমের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ছুটি ঘোষণা নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।
হাইকোর্ট গতকাল সোমবার এক আদেশে দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ২ মে (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে শিক্ষকসহ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আনা হলে শুনানি নিয়ে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতের আদেশের পর সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের বিদ্যালয় ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর লার্নিং সেন্টার আগামী বৃহস্পতিবার (২ মে) পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছুটির বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা কিছুটা ভিন্ন। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের ২৭টি জেলার মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মঙ্গলবার (আজ) বন্ধ থাকবে। এর পরদিন বুধবার মে দিবসে (১ মে) সরকারি ছুটি রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের লিখিত আদেশ পাওয়ার পর নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের লিখিত নির্দেশনা পেলে তাঁরা এ বিষয়ে (আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে করণীয়) যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
পবিত্র রমজান ও ঈদের ছুটি শেষে ২১ এপ্রিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ছিল। কিন্তু ছুটি শেষ না হতেই দেশজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়। যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি আরও এক সপ্তাহ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ছুটি শেষে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত রোববার খুললেও উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তবে প্রচণ্ড গরমে অনেক বিদ্যালয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর রোববার রাতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় সোমবার (গতকাল) মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমন সিদ্ধান্তের কথা জানালেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চলবে বলে জানায়।
প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা রাখা নিয়ে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, অসহনীয় এই তাপপ্রবাহের মধ্যে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে সমন্বিতভাবে সুস্থির সিদ্ধান্ত নেওয়া।
এর আগে গত জানুয়ারিতে তীব্র শীতে স্কুলে ছুটি দেওয়া নিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিন রকম নির্দেশনা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। আর গত বছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১৫ রমজান পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রম চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি ছিল।
এ ছাড়া এবারও পবিত্র রমজান মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দেওয়ার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
হাইকোর্টের আদেশ
হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ গতকাল স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ যে আদেশ দিয়েছেন, তাতে দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। শিক্ষাসচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিবসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদেশে বলা হয়, তবে এই সময়ে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পাবলিক পরীক্ষা, এ লেভেল এবং ও লেভেল পরীক্ষা নিতে পারে। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ (এসি) ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান চাইলে এই সময়ে খোলা রাখতে পারে।
‘তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে হিটস্ট্রোক: শিক্ষকসহ ১২ জনের মৃত্যু’, ‘হিটস্ট্রোকে এক দিনে ১৮ জনের মৃত্যুর রেকর্ড’ ও ‘দাবদাহের বিপদে রাজধানী’ শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে এনে শুনানি করেন আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান।
চলমান তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে আদালতে প্রার্থনা করেছেন বলে জানান আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিয়েছেন।
এর আগে গত রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছিল, প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলাই থাকবে। সে অনুযায়ী গতকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খোলা ছিল। কিন্তু গতকাল উচ্চ আদালতের আদেশের পর প্রাথমিক মন্ত্রণালয় তাদের আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ২ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সব জেলা (দুই জেলায় ১৮টি জেলা) এবং ঢাকা বিভাগের ঢাকা, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ, রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর এবং বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বন্ধ থাকবে।