২১ কোটি টাকার বনায়ন কোথায় জানে না কেউ
পরিচর্যার অভাবে বেশির ভাগ গাছের চারা মরে গেছে। কোথাও চারা মাথা তুলে দাঁড়ালেও গরু-ছাগল তা খেয়ে ফেলছে। আবার কোথাও চারার অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন বলছে, ৪০ শতাংশ গাছের চারা নষ্ট হয়ে গেছে।
‘বনায়নের’ এ চিত্র কক্সবাজারের আট উপজেলায় বন বিভাগের নেওয়া সবুজ বেষ্টনী সৃজন প্রকল্পের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূল রক্ষায় ইতিমধ্যে ২১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে প্রকল্পটিতে। এ টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ হয়েছে; কত চারা রোপণ করা হয়েছে, সে তথ্যও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে নেই।
এদিকে প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ক্রয় পরিকল্পনা না দিয়ে নিজেদের খুশিমতো বনায়ন করেছে বন বিভাগ। ক্রয় পরিকল্পনা দেওয়া ছাড়া কীভাবে সামাজিক বেষ্টনীর টাকা খরচ হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
২০১৯ সালে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কক্সবাজার জেলায় সবুজ বেষ্টনী সৃজন, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন’ শিরোনামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বন বিভাগ। প্রকল্পটি আগামী বছর শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে বৃক্ষরোপণ করা হয়। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় হিমছড়ি ও মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে।
সরেজমিন
প্রথম আলোর এ প্রতিবেদক ১৬ জুন কুতুবদিয়ার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখেন। সেখানে তালগাছের চারা লাগানোর কথা ছিল। কুতুবদিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ে কয়েক বছর ধরে থাকা বোটম্যান আকতার কামাল বলেন, উপজেলার মনোহরখালী থেকে নয়াপাড়া সড়কের দুই পাশে, জেলেপাড়া-গোল্ডারপাড়া মসজিদ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে, উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের আকবরবলী ঘাট থেকে দরবার ঘাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের এক পাশে, আবহাওয়া কার্যালয়, কুতুবদিয়া থানা ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয়ে ২ হাজার ৫০০ তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল। এখন গাছগুলো কী অবস্থায় আছে তাঁর জানা নেই।
উন্নয়ন বাজেট থেকে যারা টাকা নেবে, প্রকল্প প্রস্তাবে অবশ্যই ক্রয় পরিকল্পনা থাকতে হবে। গাছের চারা কে লাগাবে, কী গাছ লাগানো হবে, কত গাছ, কোথায়, শ্রমিক খরচ—সবকিছু সেখানে উল্লেখ থাকবে। বন বিভাগ যদি নিজেরাও বনায়নের কাজটি করে থাকে, তবু তাদের ক্রয় পরিকল্পনা দিতে হবে। এটি না করে তারা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।ফজলুর রহমান, সিপিটিউর সাবেক মহাপরিচালক
কুতুবদিয়া থানা, উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ও বেড়িবাঁধ ঘুরে এসব স্থানে তালগাছের চারার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের পূর্ব অংশে পাকা দেয়ালের কাছে দুই সারিতে ৬০টি তালগাছের চারা দেখা গেছে।
মহেশখালী রেঞ্জে শাপলাপুর সড়কের দুই পাশ ও পাশের একটি কবরস্থানে ২ হাজার ৫০০ তালগাছের চারা রোপণের দাবি করেন উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আয়ুব আলী। সরেজমিনে এর অর্ধেকের বেশি চারাই চোখে পড়েনি। কিছু জায়গায় চারা দেখা গেলেও রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অধিকাংশ মরে গেছে। কিছু চারা মাথা তুলে দাঁড়ালেও তা গরু–ছাগল খেয়ে ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে আয়ুব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চারাগুলো রোপণ করা হয়েছিল তিন বছর আগে। রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যায় বরাদ্দ না থাকায় ৫০০ চারা মরে গেছে, কিছু গরু–ছাগল খেয়েছে। আরও দুই হাজার গাছ এলাকায় আছে।’
বন বিভাগের শাপলাপুর বিটের মিঠাছড়ি গ্রামীণ সড়কেও তিন বছর আগে আড়াই হাজার তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল। এখন অধিকাংশ চারার অস্তিত্ব নেই। এখন কয়েক শ চারা আধমরা অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে।
শাপলাপুর বিট কর্মকর্তা নুর আলম মিয়া বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পাহাড়ি ঢলে অনেক চারা নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু চারা গবাদিপশু খেয়ে ফেলছে। রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার জন্য কোনো বাজেট নেই।’
বনায়নে নেই ক্রয় পরিকল্পনা
কক্সবাজারে সবুজ বেষ্টনী সৃজন প্রকল্প তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মূল্যায়ন করে আইএমইডি। গত মার্চ থেকে জুন—চার মাস সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ট্রেইনিং ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবেদনে বেশ কিছু অনিয়ম ও অসংগতির চিত্র উঠে আসে। তাতে বলা হয়, এ প্রকল্পে সব বিষয়ে ক্রয় পরিকল্পনা থাকলেও শুধু বনায়নের ক্রয় পরিকল্পনা নেই। বনায়নের টাকা কোথায় ও কীভাবে খরচ হয়েছে সে বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় যাচাই করে দেখতে পারে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রকল্প পরিচালক বিপুল কৃষ্ণ দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন বিভাগের কোনো প্রকল্প প্রস্তাবেই ক্রয় পরিকল্পনা দেওয়া থাকে না। এই ক্রয় পরিকল্পনা থাকে বন বিভাগের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনায়। বছরের পর বছর ধরে এটিই চলে আসছে। কারণ, চারা রোপণের সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় জড়িত থাকে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৫ কোটি টাকা ধরা হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা, প্রশিক্ষণ, প্রশাসনিক ব্যয়, জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচে। আসবাব কেনা, হিমছড়ি ও মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যয় ধরা হয় ১৬ কোটি টাকা। এই ১৬ কোটি টাকা কোথায় খরচ হবে, ক্রয় পরিকল্পনা প্রকল্প প্রস্তাবে তা তুলে ধরে বন বিভাগ। কিন্তু বাকি ২১ কোটি (সবুজ বেষ্টনীর) টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, ক্রয় পরিকল্পনায় সেটি উল্লেখ করা হয়নি। এটি এ প্রকল্পের অন্যতম দুর্বল দিক। প্রকল্পে মধ্যবর্তী মূল্যায়নের কথা থাকলেও কেন করা হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আইএমইডি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রামুর ধোঁয়া পালং রেঞ্জে ৩০ হেক্টর জমিতে বনায়ন করা হয়। তবে গৃহপালিত পশুর কারণে এলাকায় রোপণ করা চারাগুলো নষ্ট হচ্ছে। এ রেঞ্জে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা গাছের জন্য প্রকল্পের আওতায় লাগানো ছাতিয়ানিগাছের চারা বেড়ে উঠতে পারছে না।
প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের মধ্যে বিতর্ক চলার মধ্যে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা সিপিটিউ (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) বলছে, সরকারের উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা নিলে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে অবশ্যই প্রকল্প প্রস্তাবে ক্রয় পরিকল্পনা দিতে হবে। গত ৯ এপ্রিল আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবে ক্রয় পরিকল্পনা না দিয়ে বনায়নের সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে সিপিটিউর সাবেক মহাপরিচালক ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়ন বাজেট থেকে যারা টাকা নেবে, প্রকল্প প্রস্তাবে অবশ্যই ক্রয় পরিকল্পনা থাকতে হবে। গাছের চারা কে লাগাবে, কী গাছ লাগানো হবে, কতটি গাছ, কোথায়, শ্রমিক খরচ—সবকিছু সেখানে উল্লেখ থাকবে। বন বিভাগ যদি নিজেরাও বনায়নের কাজটি করে থাকে, তবু তাদের ক্রয় পরিকল্পনা দিতে হবে। এটি না করে তারা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। সরকারি কেনাকাটায় এখন ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র মতো চলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন চকরিয়া ও মহেশখালী প্রতিনিধি]