বিস্ফোরক আইনে কেন বেশি ‘গায়েবি’ মামলা, বিশ্লেষণ আসিফ নজরুলের
নির্বাচনের আগে আবার ‘গায়েবি’ মামলা দেওয়া শুরু হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের গায়েবি মামলা সচল করা হচ্ছে। গায়েবি মামলা বন্ধ না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
‘গায়েবি মামলা ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আজ রোববার এসব কথা বলেন বক্তারা। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ওয়েবিনারে বিচারক, শিক্ষক ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে গায়েবি মামলাকে দুজন আলোচক গায়েবি জানাজার সঙ্গে তুলনা করেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিশ্লেষণ করেন, কেন বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে বেশি গায়েবি মামলা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নির্বাচনে সরকারি দলের জয় নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালে গায়েবি মামলার প্রচলন হয়। রাজনৈতিক গায়েবি মামলার কারণে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ভোটের দিন মাঠে থাকতে পারেন না। এতে ক্ষমতাসীনেরা অবাধে নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে।
আলোচকদের একজন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন গায়েবি মামলাকে অসাংবিধানিক ও আইনের চরম অপব্যবহার বলে উল্লেখ করেন। গায়েবি মামলাকে গায়েবি জানাজার সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘একজন লোককে যদি দেশছাড়া করে দেন, ঘরে থাকতে না পারে, নির্বাচন তো দূরের কথা সে তো তার পরিবার-পরিজনকেই দেখতে পারবে না, স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। নির্বাচনের আগে মামলা করায় বোঝা যায়, এটা আইনের অপব্যবহার।’
এখন আইন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই উল্লেখ করে সাবেক বিচারপতি মতিন বলেন, ‘আইনের শাসন যদি না থাকে, তাহলে এই আইন দিয়ে আমরা কী করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেখতে পাচ্ছি, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। জনগণকে জাগতে হবে। যেখানে (আইনের) অপব্যবহার হবে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে।’
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পিতভাবে বিপুলসংখ্যক গায়েবি মামলা এ সরকারের আমলেই হয়েছে। সেটা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে। এর আগে কখনো হয়নি। আগামী নির্বাচনের আগে আবারও গায়েবি মামলা দেওয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনের সঙ্গে গায়েবি মামলার সম্পর্ক বিবেচনা করতে হবে। গায়েবি মামলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
রাজনৈতিক গায়েবি মামলা সাধারণত পুলিশ, পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) ও সরকারি দলের নেতারা করে থাকেন উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, এ ধরনের গায়েবি মামলা শুধু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা হয়।
আসিফ নজরুল মনে করেন, গায়েবি মামলায় নামে ও অজ্ঞাতনামা হিসেবে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করার মুখ্য উদ্দেশ্য গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে বা গ্রেপ্তার করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সংগঠকদের ভীত-সন্ত্রস্ত রাখা এবং তাঁদের এলাকাছাড়া করা।
বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে বেশি গায়েবি মামলা হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করেন আসিফ নজরুল। তাঁর মতে, ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৫ ধারায় মামলা করা যায়, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ২০ বছরের কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ। বিস্ফোরক এ আইনে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এ কারণে কাউকে এ আইনের মামলায় আসামি করা হলে তিনি প্রচণ্ড ভীত থাকেন।
অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আইন কর্মকর্তা রিদওয়ানুল হক বলেন, পুলিশ স্টাডি (পর্যালোচনা) করে গায়েবি মামলা দেয়। যাঁরা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশগুলো আয়োজন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এ মামলা দেওয়া হচ্ছে, যাতে সামনে তাঁরা এ কাজ না করতে পারেন।
গায়েবি মামলা থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে আগামী নির্বাচনের ফল সুখকর হবে না বলে উল্লেখ করেন রিদওয়ানুল হক। তিনি বলেন, এর নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্যে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিক্ষক জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে যে গায়েবি মামলা করা হয়েছে, তা চরিত্রগত দিক থেকে একেবারেই আলাদা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনকে তাদের মতো ম্যানিপুলেট (কারসাজি) করা।’
জাহেদ উর রহমান বলেন, গায়েবি মামলা করা হয় হয়রানির উদ্দেশ্যে, বিচারের উদ্দেশ্যে নয়।
বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘ঘটনা কল্পিত, এ রকম মামলা আমরা প্রথম গণহারে দেখি ২০১৮ সালের আগস্টে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়। ওই সময় কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয় প্রথমে সিলেট অঞ্চলে। তখন গায়েবি মামলা নিয়ে প্রথম রিপোর্ট হয়।’
গোলাম মর্তুজা বলেন, ওই সময় গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে শিক্ষার্থীদের নামে প্রচুর মামলা দেওয়া হয়। ঢাকায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়। এই যে ট্রেন্ড (প্রবণতা) চালু হলো, তা পরে চলতে থাকল নির্বাচন পর্যন্ত।