সাইফুদ্দিন, আল আমিন, কালু ও শরীফ—এখন থেকে এক চোখেই পৃথিবী দেখবেন এই তরুণেরা

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্প্রতি দেখা করেন আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ তরুণদের কয়েকজনছবি: সংগৃহীত

কেমন আছেন, জানতে চাইলে সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ এমদাদ বলেন, ‘সুস্থ আছি বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে চেষ্টা করছি ভালো থাকার। গুলি লাগা ডান চোখে শুধু সাদা আলো দেখি। বিব্রত লাগে। গুলি লাগার পরই চোখের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলি লেগেছিল, সেখানেও যন্ত্রণা আছে। লাঠি ও হুইলচেয়ার ছাড়া একা হাঁটতে পারি না এখনো।’

সাইফুদ্দিন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে হওয়া আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। কোটা সংস্কারের এ আন্দোলনই একসময় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের।

গত ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে পুলিশের সঙ্গে তর্ক করেন সাইফুদ্দিন। সে ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। গোয়েন্দা নজরদারির ফলে তাঁকে ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে যেতে হয়। সেখানেও টিকতে না পেরে সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তিন দিন আত্মগোপনেও থাকতে হয়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন চট্টগ্রাম শহরের পুলিশ লাইনসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারান ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ।

সুস্থ অবস্থায় তরুণ সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ
ছবি: সংগৃহীত

গত শনিবার মুঠোফোনে সাইফুদ্দিন বলেন, ‘১৯ জুলাই বায়তুল মোকাররমের সামনে একজনের মাথায় গুলি লেগে বের হয়ে গেলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেখানেই তিনি মারা যান। ভাগ্য ভালো, গুলিটি আমার গায়ে লাগেনি। আর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পুলিশকে বারবার ফায়ার করতে না করেছিলাম। কিন্তু শোনেনি। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য করছে, তা মনে হয়নি, মানুষ মেরে ফেলার জন্যই এমন আচরণ করেছিল।’

৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, সিএমএইচ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ল্যাবএইড, বাংলাদেশ আই হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছেন সাইফুদ্দিন। এতে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ভোগান্তি বেড়েছে। আর যাতায়াতসহ অন্যান্য খাতে খরচ তো আছেই।

আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালগুলোতে গুণগত মানের চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এ নিয়ে সোচ্চার ঢাকার সরকারি মাদ্রাসা–ই–আলিয়ার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন। সম্প্রতি বিভিন্ন দাবি জানাতে তিনিসহ আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন।

শরীফ মিজির বয়স ২৬ বছর। বাবা মারা গেছেন। দুই বছর বয়সী এক ছেলের বাবা শরীফ সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী ছিলেন। গত ১৭ জুলাই মিরপুরে দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে ব্যবসা বন্ধ। ৫ আগস্ট মিরপুর মডেল থানার সামনে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন। এর আগেও আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সময় তাঁর শরীরে ছররা গুলি লেগেছিল।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাইফুদ্দিন তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, চোখের জন্য এক হাসপাতাল, নার্ভের জন্য এক হাসপাতাল, হাঁটতে না পারার জন্য আরেক হাসপাতাল—তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় এভাবে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হয়। সরকার যদি প্রতিটি হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ইউনিট করে, চিকিৎসকদের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সমন্বিত চিকিৎসা দেয়, তবে তাঁরা উপকৃত হতেন।

সাইফুদ্দিনের বাবা সরকারি ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে অবসরে। ভাই জুনাইদ আবদুল্লাহ অনার্সে পড়ছেন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে সাইফুদ্দিন কারও বোঝা হয়ে থাকতে চান না। পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতে চান। মানুষের জন্য কাজ করেন তিনি। তাই ভবিষ্যতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চান।

আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
গুলি লাগা চোখে আর দেখতে পাব, তেমন সম্ভাবনা নেই। সরকার যদি ভাতা দেয় ও পুনর্বাসন করে, সে আশায় বসে আছি।
আল আমিন, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ তরুণ

আন্দোলনে চট্টগ্রামের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন সাইফুদ্দিন। তবে এখন সমন্বয়ক পরিচয় দিতে বিব্রত বোধ করেন বলে উল্লেখ করে বলেন, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী শব্দগুলো এখন গালিতে পরিণত হয়েছে। আর যে স্বপ্ন দেখে আন্দোলন করেছেন, তার মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ছাড়া সাম্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিদেশে যাওয়া আর হলো না

মো. আল আমিন

২১ বছর বয়সী মো. আল আমিন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে বাঁ চোখে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। দুটি গুলির মধ্যে একটি চোখের ভেতরে রয়ে গেছে। প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়, তারপর ওই দিনই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ৫ আগস্ট হাসপাতাল থেকে ছুটি পান। এরপর আবার ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ সেপ্টেম্বর এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছররা গুলিতে ৪০১ জনের চোখ নষ্ট হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ১৯ জন। এক চোখ নষ্ট হয়েছে ৩৮২ জনের। এ ছাড়া দুজনের দুই চোখে ও ৪২ জনের এক চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে।

আল আমিনের বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বড় ভাই ও বোনের বিয়ে হয়েছে। টিউশনি ও টুকটাক কাজ করে মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে থাকেন আল আমিন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘ঋণ করে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যেতে চেয়েছিলাম, ভিসাও পেয়েছিলাম। ভিসার মেয়াদ আছে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। এখন তো চোখের এ অবস্থা নিয়ে বিদেশে গিয়ে লাভ নেই। টাকাটাই নষ্ট হলো।’ তিনি বলেন, ‘গুলি লাগার পর প্রথম দিনের অস্ত্রোপচারসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজে এ পর্যন্ত ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখনো বলতে গেলে ঋণের টাকাতেই চলছি, শোধ করব কীভাবে জানি না।’

আল আমিন বলেন, ‘গুলি লাগা চোখে আর দেখতে পাব, তেমন সম্ভাবনা নেই। সরকার যদি ভাতা দেয় ও পুনর্বাসন করে সে আশায় বসে আছি।’

পরিবার নিয়ে অনিশ্চিত পথে যাত্রা

মো. কালু

মো. কালু মিরপুর ১৩ নম্বরে অটোরিকশা চালাতেন। ১৮ জুলাই তিনি মিরপুর ১০ নম্বরে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন। চোখে এখনো গুলি রয়ে গেছে। কালু বলেন, ‘২৬ বছর দুই চোখে দেখেছি, এখন এক চোখে দেখি না। বাকি জীবন এক চোখেই পৃথিবী দেখতে হবে।’ চিকিৎসার টাকার জন্য কালু তাঁর অটোরিকশাটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন বেকার বসে আছেন।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ২৬ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন কালু। পাঁচ বছর আর দুই বছর বয়সী দুই মেয়ের বাবা কালু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৬০ হাজার টাকার মতো সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান। গত রোববার মুঠোফোনে বলেন, ‘ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। বাড়িভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে পারতেছি না তিন মাস ধরে। হাওলাত করে আর কত দিন চলা যায়।’

মো. শরীফ মিজির

মো. শরীফ মিজির বয়স ২৬ বছর। বাবা মারা গেছেন। দুই বছর বয়সী এক ছেলের বাবা শরীফ সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৭ জুলাই মিরপুরে দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে ব্যবসা বন্ধ। ৫ আগস্ট মিরপুর মডেল থানার সামনে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন। এর আগেও আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সময় তাঁর শরীরে ছররা গুলি লেগেছিল। ছররা গুলির একটি চোখে লাগে। তিনি পরিবারের বড় ছেলে।

গত রোববার মুঠোফোনে শরীফ জানান, দুদিন আগে তিনি চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। ঢাকায় থাকার মতো অবস্থা নেই। এইচএসসি পর্যন্ত পড়া ভাই তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করতেন, সেই ভাইকেও গ্রামে চলে যেতে হয়েছে। শরীফ বলেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি আপাতত ভারী কাজ করতে পারবেন না। চোখের এ অবস্থা নিয়ে কে তাঁকে কাজ দেবেন, তা–ও বুঝতে পারছেন না।

আল আমিন, কালু ও শরীফের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে, আহত ব্যক্তিদের সেভাবে খোঁজখবর নিচ্ছে না। অথচ তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনেও সমান মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসা যথাযথ না হলে অনেকেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। এটা রাষ্ট্রের জন্যও ভালো হবে না।

আন্দোলনে চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়া তিন তরুণ (বাঁ থেকে) মো. আল আমিন, মো. শরীফ ও মো. কালু
ছবি: মানসুরা হোসাইন
ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। বাড়িভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে পারতেছি না তিন মাস ধরে। হাওলাত করে আর কত দিন চলা যায়।
মো. কালু, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ তরুণ

আল আমিন বলেন, যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর সবার আগে আহত ব্যক্তিদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে যুদ্ধের রীতি। দেশ সংস্কার হচ্ছে, সংস্কারের পর দেশের সৌন্দর্য দেখার জন্যও তো চোখে দেখতে হবে।

শরীফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় সমন্বয়কদের কেউ কেউ কথা বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন। তবে আর খোঁজ নেননি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা ছাড়া আর কোনো সহায়তা পাননি।

আরও পড়ুন

আল আমিন, কালু আর শরীফের সঙ্গে গত ২৩ সেপ্টেম্বর দেখা হয় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে। তখনো তাঁরা তাঁদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকা
ফাইল ছবি

১০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে ‘আন্দোলনে গুলিতে চোখ নষ্ট ৪০১ জনের’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছররা গুলিতে ৪০১ জনের চোখ নষ্ট হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ১৯ জন। এক চোখ নষ্ট হয়েছে ৩৮২ জনের। এ ছাড়া দুজনের দুই চোখে ও ৪২ জনের এক চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন