পোষা প্রাণীদের ‘মমতাঘর’

রাজশাহী নগরের রানীনগর এলাকায় নিজের বাড়িতে পোষা প্রাণীদের সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন ফাহমিদা রহমান। সম্প্রতি তোলা ছবিছবি: শহিদুল ইসলাম

দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে তখন। সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও চলছে বিধিনিষেধ। মানুষ ঘরবন্দী। জনমনে আতঙ্ক। কুকুর-বিড়াল থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, এমন গুজবও উঠেছে। এ সময় বাড়ির বাইরে চোখ না–ফোটা একটা বিড়ালছানা দেখে বাসায় নিয়ে যান ফাহমিদা রহমান। মা–বাবা রাগ করেন কি না, সেই ভয় ছিল। তবে বাড়িতে প্রশ্রয়ই পেল ছানাটি। নাম দেওয়া হলো ‘কোভিড’।

এর পর থেকে বাড়ির বাইরে গেলেই বিড়ালছানার কান্না শুনতে পান ফাহমিদা। কাতর চোখের বিড়ালছানাগুলো দেখলেই মায়া লাগে তাঁর। শেষমেশ পথ থেকে তুলে ছানাগুলো বাসায় নিয়ে আসেন। এভাবেই ফাহমিদার বাড়িতে জায়গা পেল ওরিও, লিলি, টিমটিম, নিকো ও মাফিন। সবই ফাহমিদার দেওয়া নাম। এভাবেই ২০২০ সালের জানুয়ারি নাগাদ ফাহমিদার বাড়িতে জুটে গেল ১৫টি বিড়াল।

এমন সময় ফাহমিদার এক বান্ধবী এল তাঁদের বাড়িতে। বাড়িতে এক ডজনের বেশি বিড়ালছানা দেখে নিজের পোষা বিড়ালটি ফাহমিদার কাছে রাখার প্রস্তাব দিল। জানাল, সে অনেক দিনের জন্য বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। বিড়ালটা ফাহমিদা যদি তাঁর কাছে রাখে, তাহলে এর জন্য মাসে মাসে সে খরচ পাঠাবে। বান্ধবীর কাছ থেকে পাওয়া এই প্রস্তাব নতুন করে ভাবাল ফাহমিদাকে। ভাই মাহফুজ প্রদীপকে বিষয়টি জানাল। বুদ্ধি–পরামর্শ করে ভাই–বোন মিলে ‘আবাসিক পশু হাসপাতাল’ খুলে বসলেন। নাম দিলেন ‘পজ স্টেপ’।

ফাহমিদা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক করেছেন। তাঁর বড় ভাই মাহফুজ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সিএসই) পড়েছেন। একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত তিনি। তাঁদের বাড়ি রাজশাহী নগরের রানীনগর এলাকায়। বাড়ির একটি অংশ নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘পজ স্টেপ’। সেখানে রয়েছে ২৩টি বিড়াল, ৪টি খরগোশ, ২টি কুকুর ও ১টি পাখি।

সম্প্রতি ফাহমিদাদের বাড়ি গেলে পজ স্টেপের বাইরের দরজা খুলতেই দুটি জার্মান শেফার্ড এসে একরকম জড়িয়ে ধরল। বিড়ালের ঘরে গিয়ে মনে হলো তারা সবচেয়ে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে। কেউ শুয়ে আছে, কেউ খাচ্ছে।

পজ স্টেটে থাকা বিড়ালগুলোর মধ্যে দুটির নাম কুকি ও ক্যান্ডি। বিড়াল দুটি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষক সাদিয়া সাত্তারের। পিএইচডি গবেষণার জন্য বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। সর্বশেষ দেড় বছর আগে কুকি ও ক্যান্ডির সঙ্গে দেখা করে গেছেন তিনি।

মুঠোফোনে কথা হলো সাদিয়ার সাত্তারের সঙ্গে। বললেন, ‘ফাহমিদার কাছে বিড়াল দুটো রেখে আমি একেবারে নিশ্চিন্ত থাকি। ও খুব যত্ন করে। ছবি পাঠায়। সর্বশেষ যখন দেখতে গেলাম, তার আগে এক বছরের বেশি ওদের সঙ্গে আমার দেখা নেই। তখনো ২২-২৩টি বিড়ালের মধ্যে আমার কুকি ও ক্যান্ডি সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই ঘুরছিল। আমি কোথাও গিয়ে বসলে ওরা আমার কাছে ঘুরঘুর করছিল।’

একটি র‌্যাকের ওপরে খুব আয়েশ করে শুয়ে ছিল টুল ও টুলি। বিড়াল দুটি দুই বোন আলভি ও অনন্যার। তাঁদের বাড়ি নওগাঁয়। তাঁরা বাইরে পড়াশোনা করতে যাবেন। কিন্তু এতে বাদ সাধে বিড়াল। তাঁদের আদরের বিড়াল দুটির দেখাশোনার দায়িত্ব বাসায় কেউ নিতে চাননি। তাই তাঁরা বিড়াল দুটিকে ফাহমিদার পজ স্টেপে রেখে গেছে। হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে দুই বোন বিড়াল দুটির খরচ দেন।

বিয়ের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে বিড়াল থাকায় মধুচন্দ্রিমায় যেতে পারছিলেন না চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবুল বাশার ও ফারজানা দম্পতি। তাঁদের পোষা বিড়াল ফিওনা, ফ্লোরা ও টাইগারকে বাসায় রেখে বের হতে পারছিলেন না। এর মধ্যে একদিন জানতে পারলেন, রাজশাহীতে পজ স্টেপে বিড়াল রেখে বেড়াতে যেতে পারবেন। পজ স্টেপের কল্যাণে অবশেষে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

ফাহমিদার ভাই মাহফুজ হিসাব দিলেন, পজ স্টেপের জন্য তাঁদের মাসে ৪০ কেজির বেশি মুরগি, ১০০ কেজির বেশি মাছ ও ১ মণ চাল কিনতে হয়। তাঁদের মা ফাতেমা খাতুন এসে গল্পে যোগ দিলেন। বললেন, বাড়ির অন্য সদস্যদের মতো এসব প্রাণীর খাবারও তিনিই রান্না করেন।

ফাতেমা খাতুনের কথা বলার সময় ব্লু নামের একটি বিড়ালকে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছিলেন ফাহমিদা। এর পাশের টেবিলে এসে বসল জ্যাক নামের একটি সাদা রঙের বিড়াল। মিউ মিউ করছিল। তার দিকে ফাহমিদা খেয়াল না করায় টেবিলের নিচে গিয়ে শটান শুয়ে পড়ল। বোঝা গেল অভিমান করেছে। সব দেখে মনে হলো টুলু, টুলি ও কুকিরা সেখানে পারিবারিক পরশে পরম মমতায় বেড়ে উঠছে।