সব মিলিয়ে ৮৫টি চিঠি। বেশির ভাগ বাংলায় লেখা। কোনো কোনোটা ইংরেজিতে। বাংলা চিঠির কোনোটাতে আবার ভাষা ঠিক নেই, বানান ভুল, মাঝেমধ্যে সাধু-চলিতের মিশেল, কখনো বাক্য অসম্পূর্ণ। তবে ভাষা বা প্রকাশভঙ্গি যা-ই হোক, ব্যক্তিগত দুঃখ ছাপিয়ে চিঠিগুলোর ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে আছে একটি দেশের জন্মকথা।
সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে একাত্তরের ৯ মাসজুড়ে প্রিয়জনদের এসব চিঠি লিখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তিন যুগের বেশি সময় ধরে যক্ষের ধনের মতো এগুলো আগলে রেখেছিলেন তাঁদের নিকটজনেরা। লেখার ৩৮ বছর পর ২০০৯ সালে সেগুলোই পরম বিশ্বাসে প্রথম আলো আর গ্রামীণফোনকে তুলে দেন তাঁরা। এত দিন যা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত দুঃখের স্মারক, এই প্রথম সেগুলোকে প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন তাঁরা, করে তুললেন জাতীয় স্মৃতির অংশ।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চিঠি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় প্রথম আলো আর গ্রামীণফোন। সংবাদ সম্মেলন করে আর সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর শুরু হয় চিঠি সংগ্রহের কাজ। সারা দেশ থেকে পাওয়া যায় বিপুল সাড়া—কেউ চিঠিতে, কেউ ফোনে, কেউবা সরাসরি প্রথম আলো কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন।
সব মিলিয়ে জমা পড়ে পৌনে দুই শর মতো চিঠি। এরপর শুরু হয় বাছাইপর্ব। প্রথমেই বাদ দেওয়া হয় সেই চিঠিগুলো, একাত্তরে লেখা হলেও যেখানে মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। এরপর চলে চিঠির যথার্থতা বিচার। যাচাই করতে অনেক ক্ষেত্রেই পত্র প্রাপক বা লেখকের বাড়ি পর্যন্ত গেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি। আর পুরো কাজ তদারক করেছে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি। কমিটির সভাপতি ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ। সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার ও সেলিনা হোসেন এবং নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর যাচাই-বাছাইয়ে শেষ পর্যন্ত চিঠি টিকে থাকে মাত্র ৮৫টি।
গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাই যেখানে সোয়া দুই লাখের বেশি, সেখানে বলতেই হবে, চিঠির এই সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে মনে রাখতে হবে, তখন দেশে যুদ্ধ চলছিল। ডাকব্যবস্থা ধসে পড়েছিল, এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। ফলে অনেক চিঠি প্রাপকের হাতে পৌঁছাতেই পারেনি। আবার প্রাপকের কাছে পৌঁছানোর পরও শত্রুপক্ষের হাতে পড়ার ভয়ে পাঠ করার পরপরই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বহু চিঠি।
তারপরও টিকে যাওয়া চিঠির সংখ্যা নিশ্চয়ই এত কম ছিল না। যুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই যদি উদ্যোগটা নেওয়া হতো, নিঃসন্দেহে বলা যায়, চিঠির সংখ্যা হতো এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু কাজটা শুরু করতেই লেগে গেছে ৩৮ বছর। তত দিনে কত কিছু ঘটে গেছে, মারা গেছে মানুষ, বদলে গেছে ঘরবাড়ি, কীটপতঙ্গে নষ্ট হয়েছে কত দলিল, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় ভেসে গেছে কত জনপদ। আরও অজস্র স্মারকের মতো চিরতরে হারিয়ে গেছে কত চিঠি। তবু বলতেই হয়, এটুকু তো অন্তত রক্ষা পেল।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই চিঠিগুলো? এই ৮৫ চিঠি আসলে তুলে ধরেছে সারা দেশের যন্ত্রণা, ত্যাগ আর স্বপ্ন। বাঙালির ইতিহাসে একাত্তর যে কী ছিল, এসব চিঠি পড়লে সরাসরি আভাস পাবেন পাঠক। বহু ইতিহাস বই মিলে যা করতে পারে না, এ ধরনের একটি বই-ই তা করতে পারে। যুগ যুগ ধরে এমনটিই করে আসছে অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি বা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির মতো বই। একাত্তরের চিঠির অসম্ভব গুরুত্ব ঠিক এখানেই।
এই বই দিয়েই ২০০৯ সালের ২৭ মার্চ যাত্রা শুরু করে প্রথমা প্রকাশন। বইটির প্রকাশ উপলক্ষে সেদিন রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে সুধী সমাবেশের আয়োজন করেছিল প্রথম আলো ও গ্রামীণফোন। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং গ্রামীণফোনের সে সময়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওডভার হেশডেজাল।
১৩ বছরের মাথায় সেই বইয়ের আজ সুবর্ণ সংস্করণ প্রকাশ করছে প্রথমা। নন-ফিকশন বই চলে না—এ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে একাত্তরের চিঠি। এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে বইটির দেড় লাখ কপি। এই বিপুল বিক্রিই প্রমাণ করে, বাঙালির হৃদয়ে এখনো কী গভীরভাবে গ্রথিত হয়ে আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।