রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলালেও নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র আগের মতোই
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পশ্চিমদী সড়ক থেকে গত ৯ আগস্ট তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় ২১ ও ২২ বছরের দুই তরুণীকে। তাঁদের একজন পোশাককর্মী, অন্যজন বিউটি পারলারকর্মী। একটি বাড়িতে আটকে রেখে ছয়জন তাঁদের দলবদ্ধ ধর্ষণ করেন। পারলারকর্মী রাতেই পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। পরে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের কাছে ঘটনা খুলে বললে পরদিন সকালে অপর তরুণীকে উদ্ধার করা হয়।
এদিকে ত্রাণের আশায় কয়েকজন নারীর সঙ্গে ঢাকায় এসে গত ৭ সেপ্টেম্বর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ৬৫ বছর বয়সী এক নারী। পরদিন লোকজন ৯৯৯–এ কল করলে শাহবাগ থানা-পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এমন পরিবর্তনেও দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্রে বদল হয়নি। এ–সংক্রান্ত মাসভিত্তিক মামলার তথ্য সে চিত্রই তুলে ধরছে।
ভুক্তভোগী তিনজন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি ছিলেন। সবশেষ বয়স্ক নারীকে তাঁর ছেলে ওসিসি থেকে বাড়ি নিয়ে গেছেন। দুই তরুণী মামলার জন্য থানায় যোগাযোগ রাখছেন।
সারা দেশে অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার এ মাত্র তিন উদাহরণ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এমন পরিবর্তনেও দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্রে বদল হয়নি। তা রয়ে গেছে আগের মতোই। এ–সংক্রান্ত মাসভিত্তিক মামলার তথ্য সে চিত্রই তুলে ধরছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর বিভিন্ন ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। মামলার অর্ধেকই ধর্ষণ ও ধর্ষণেচেষ্টার অভিযোগে করা হয়েছে। এ সংখ্যা ৬ হাজার ২০২।
এসব মামলার মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ হাজার ৩৩২টি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১ হাজার ৮৭০টি মামলা হয়। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনায় ৩ হাজার ২০৮টি, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপের কারণে ৪৭, অপহরণের ঘটনায় ৩ হাজার ২৮৭ এবং শিশু পণবন্দী করে রাখার অভিযোগে ২৫টি মামলা হয়েছে।
মামলার তথ্য বলছে, ওই সময়ে যৌতুকের কারণে ১৩৬ নারী এবং ধর্ষণের পর ১২ নারী ও ১১ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধগুলো সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ঘটছে। সামাজিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, পারিবারিক বন্ধন দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও নির্যাতন কমছে না।
সর্বশেষ গত মাসের কিছু ঘটনা
গত মাসেও নারী ও শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত ঘটনার একটি ছিল রাজধানীর বনানী এলাকায় গত ১২ অক্টোবর নিম্নবিত্ত পরিবারের এক শিশুকে (৯) এক ব্যক্তি একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় শিশুর মাসিক ও মলত্যাগের রাস্তা এক হয়ে গেছে।
১৯ অক্টোবর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় গৃহকর্মী কল্পনাকে (১৩)। বাসার মালিক দিনাত জাহান তাঁকে নির্যাতন করতেন। কল্পনাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁর সামনের চারটি দাঁত ভাঙা, সারা গায়ে মারধর ও ছ্যাঁকার ক্ষত ছিল।
বনানীতে ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে ওসিসি থেকে বাড়ি নিয়ে গেছেন মা–বাবা। আর গৃহকর্মী কল্পনা এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
এরই মধ্যে ২১ অক্টোবর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের দুর্গম চরে মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
এ পরিস্থিতিতে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সারা দেশে ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ (দ্রুত সাড়াদানকারী দল) গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, এ দলে প্রশাসন, পুলিশ, আইনজীবী, কাউন্সিলর ও তরুণ সমাজের উপস্থিতি থাকবে। যে করেই হোক নির্যাতন কমিয়ে আনা এ সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
‘পুলিশশূন্য সময়’ আগস্টে থানায় সবচেয়ে কম মামলা
হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা ও পুলিশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পুলিশের অনুপস্থিতিতে কোনো কোনো থানায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কোনো কোনো নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়নি, কোনো ঘটনায় আবার মামলা করতে দেরি হয় ভুক্তভোগীদের।
৯ আগস্ট দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দুই তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ২৩ দিন পর ২ সেপ্টেম্বর মামলা হয়। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক নয়ন কারকুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে মামলা দেরিতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শিপন মোল্লা (২৬) নামের এক আসামিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। এরপর মামলা হয়। অন্য পাঁচ আসামিকে ধরার চেষ্টা চলছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় থানাগুলোতে সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে আগস্টে। অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে ১৩ থেকে ৪৭ শতাংশ মামলা কম হয়েছে। জানুয়ারিতে ৭৮৬, ফেব্রুয়ারিতে ৯৯৩, মার্চে ১ হাজার ১০০, এপ্রিলে ১ হাজার ২৩৬, মে মাসে ১ হাজার ২৯০, জুনে ১ হাজার ১৯১, জুলাইয়ে ১ হাজার ২৪০, আগস্টে ৬৮৪ ও সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৭১টি মামলা হয়। এর বাইরে আদালতে থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে থানায় মামলা হয় ৩ হাজার ১৭৮টি।
এ তথ্য থেকে দেখা যায়, আন্দোলনের উত্তাল সময় জুলাই মাসেও নারী ও শিশু নির্যাতনের হার ছিল উচ্চ। তবে ওসিসিতে গিয়ে দেখা যায়, ১৬ জুলাই থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা কম এসেছে। ওসিসির সমন্বয়কারী চিকিৎসক সাবিনা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে জানান, পরিস্থিতির কারণে ভুক্তভোগী কম এসেছিল। কোনো ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মামলা পরে হয়েছে।
১৩ জুলাই দক্ষিণখানে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী (৩১)। ওসিসিতে তিনি ভর্তি হন ১৭ জুলাই। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এক নারী কেরানীগঞ্জ থেকে ওসিসিতে আসেন ২৪ জুলাই। প্রতিবেশীর মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়ে ২৯ ও ৩০ জুলাই নবাবগঞ্জ এবং কেরানীগঞ্জ থেকে দুই কিশোরী ভর্তি হয় সেখানে। ১ ও ৩ আগস্টও ভুক্তভোগীরা ভর্তি হয়। তবে ৪ থেকে ৯ আগস্ট ভুক্তভোগীরা এখানে আসতে পারেননি।
বিচার চাওয়া নিয়ে আস্থা তৈরি করা জরুরি
নারী ও শিশু নির্যাতন, এ–সংক্রান্ত মামলা ও বিচার পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধগুলো সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ঘটছে। সামাজিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, পারিবারিক বন্ধন দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও নির্যাতন কমছে না।
অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, প্রচলিত বিচারব্যবস্থা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াও নির্যাতন না কমার অন্যতম বড় কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়—নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন; পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বন্ধন শক্তিশালী করা, যেকোনো কাজে কমিউনিটির জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
ভুক্তভোগীদের বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান অধ্যাপক উমর ফারুক।