সংবিধান সংস্কার কমিশনের এক মতবিনিময় সভায় সংবিধান সংস্কার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, গণভোট, নির্বাচনব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে প্রস্তাব উঠে এসেছে বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এই মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন কাজ শুরু করেছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি কমিশন সরকারের কাছে তাদের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন গত সোমবার থেকে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে তারা।
সভা শেষে সংবিধান সংস্কার কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সংস্কারের বিভিন্ন দিক নিয়ে মত দেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, আলেম ও গবেষক মুসা আল হাফিজ, মানবাধিকার কর্মী শাহিন আনাম, ড. শহিদুল আলম এবং মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী।
সভা সূত্রে জানা গেছে, মতবিনিময় সভায় সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কীভাবে অনুমোদন করা যায় তা নিয়ে দুই ধরনের মত এসেছে। এর একটি হলো গণপরিষদ গঠন করে সংবিধানের অনুমোদন দেওয়া। আরেকটি হলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সংসদে সংবিধানের সংশোধনী অনুমোদন করবে। অবশ্য সংবিধানের সংশোধনী কিভাবে বাস্তবায়ন বা অনুমোদন করা হবে তা সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যপরিধিভুক্ত নয়। এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। কমিশনের কাজ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে তা সরকারের কাছে দেওয়া।
সভায় অংশ নেওয়া স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির পর একটি গণপরিষদ নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। এই গণপরিষদ সংবিধান অনুমোদন করবে। এ ছাড়া তিনি প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা না করে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক সংস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার ও শাসন কমিশন নামে একটি কমিশন করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে সংবিধান অনুমোদন করা নিয়ে ভিন্ন মত দেন অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সভায় বলেছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি খসড়া শাসনতন্ত্র লিখবে। সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদনের ঘোষণা দিলে সমস্যা বাড়বে। তাঁর প্রস্তাব হলো—খসড়া শাসনতন্ত্র পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। সংসদে আলোচনা করে সেটিকে আরও শুদ্ধ করে গ্রহণ করবে। পরে এটি নিয়ে যাতে গণভোট করা যায়।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার—এই তিন বিষয়কে সংবিধানের মূলনীতি ঘোষণা করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে কিছু ভারসাম্য আনা, জাতির পিতা প্রশ্নে ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ ধারণায় যাওয়া, গণভোট চালু করা, প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার বিধান না করা, আনুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতিতে না যাওয়া, কখন জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে তা সংবিধানে স্পষ্ট করা, সংবিধানের পরিশিষ্টে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তালিকা দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন।
মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দেবে। কিন্তু কীভাবে এই সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদন করা হবে তা পরিষ্কার নয়। এখানে কি গণপরিষদ করা হবে, নাকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংবিধান সংশোধন করার কোনো পদ্ধতি নেই। সংবিধান সংশোধন অধ্যাদেশ করে করা যাবে না। তিনি সভায় বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মাসদার হোসেন মামলার রায় পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মতবিনিময় সভায় সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী ও ফিরোজ আহমেদ অংশ নেন।