ইন্ধনদাতারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় বলে জানিয়েছেন সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ ইন্তেখাব হায়দার খান। ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আয়োজিত এ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ইন্ধনদাতাদের পরিচয় এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। একেকজনের মোটিভ (উদ্দেশ্য) একেক রকম। কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকতে পারে, আবার অন্য স্বার্থও থাকতে পারে। তাদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইন্ধন জোগাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা।
ইন্ধনদাতারা যুগে যুগে ছিল, থাকবে—এমনটি উল্লেখ করে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে ইন্ধনে প্রভাবিত না হওয়া। তাহলে ইন্ধনদাতাদের প্রভাব অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ইন্ধনদাতা একটি পোস্ট করার পর সেটি না বুঝেই অনেকে ছড়িয়ে দেন। যেসব ইন্ধনদাতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ব্রিফিংয়ে চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় গত মঙ্গলবারের বিশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রামের আদালতে নেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিতি ছিলেন। তারপরও সেখানে বিশৃঙ্খলা হয়েছে, একজন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, মৃত্যুর ঘটনাটি অবশ্যই অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং সার্বিক প্রচেষ্টা থাকবে, যেকোনো ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধ করা। সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তার কারণে আরও অনেক বড় ঘটনা ঘটেনি। সেখানে আদালত প্রাঙ্গণে এবং রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা কী রকম ছিল? সেই পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু ঘটনাটি আরও খারাপ হতে পারত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে পুরো ঘটনা অনেকটা কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) করা গেছে।
সম্প্রতি যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা–ভাঙচুর এবং ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় সেনাসদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়নি, পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, যাত্রাবাড়ীর ঘটনার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এরই মধ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিটি ঘটনা আলাদাভাবে বিচার করা প্রয়োজন। এখানে অপরাধীরা আছে, ইন্ধনদাতারা আছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাজ করছে ইন্ধনদাতারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা মূলত থাকে অপরাধী এবং ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে।...কিন্তু ছাত্ররা যখন কারও ইন্ধনে পরিস্থিতি না বুঝে বেরিয়ে যায়, তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে হলে একটু চিন্তা করে কাজ করতে হয়।
গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি নেই
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি আছে কি না, জানতে চাইলে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের কোনো ঘাটতি নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করেছে সেনাবাহিনী। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিন্তা করে কাজটা করতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অনেকের মনে হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখা যায়, এমন না–ও হতে পারে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অনেক ঘটনা ঘটার আগেই সমাধান করা হয়েছে।
বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পাওয়ার পর অভিযানে গিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে—এমন এক প্রশ্নের জবাবে সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত কেউ অপরাধে জড়িয়েছেন, এমন তথ্য তাঁর জানা নেই। তবে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনাসদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সে সংখ্যা কত, এ মুহূর্তে সেই তথ্য নেই। তবে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তদন্ত হয়েছে। কিছু ঘটনার তদন্ত এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তিদের চার বছরের জেল থেকে শুরু করে এক বছরের জেল, চাকরিচ্যুত করাসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করছে সেনাবাহিনী
প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতেই সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, এই ব্রিফিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এর আগে ১৩ নভেম্বরের প্রেস ব্রিফিংয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। এই ব্রিফিংয়ে গত দুই সপ্তাহের কার্যক্রম তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি বলেন, ১৩ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ২৪টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৩৬৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া একই সময়ে যৌথ অভিযানে মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২২৮ জনকে এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১ হাজার ৩২৮ জনকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে জানান ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির কর্মকর্তাদের ৬০ দিনের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ ক্ষমতা ১৫ নভেম্বর থেকে আরও ৬০ দিনের জন্য বর্ধিত করা হয়েছে।
কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ৩ হাজার ৪৩০ জনকে দেশের বিভিন্ন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৫ জন এখনো চিকিৎসাধীন। এখন পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি আহত ব্যক্তির অস্ত্রোপচার হয়েছে। এ ছাড়া চারজন গুরুতর আহত রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
গত ২০ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর ১ জন কর্মকর্তা নিহত এবং ১২২ জন সদস্য আহত হওয়ার তথ্য ব্রিফিংয়ে জানান কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান।