খাগড়াছড়িতে গুলিতে আহতদের দুঃস্বপ্নের ঘোর

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় তিনজন নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি শহরের বনরূপা এলাকায় পৌঁছালে জনতা তাঁদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। রাঙামাটি শহরের উত্তর কালিন্দীপুর এলাকায়ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাঁ ঊরুতে ঢুকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বের হয়ে যায় গুলি। হাড় ও পেশিতে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। রাজমিস্ত্রি নলেজ চাকমার (৩৫) পায়ে গত মঙ্গলবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনো যন্ত্রণায় কাতর তিনি। কবে বাড়ি ফিরবেন, আগের মতো কাজ করতে পারবেন কি না, জানেন না।

দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের জের ধরে ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে শহরের স্বনির্ভর এলাকায় নলেজ চাকমা গুলিবিদ্ধ হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এ সময় অন্তত ২০ জন আহত হন। বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। মারা যান দুজন—রুবেল ত্রিপুরা (২১) ও জুনান চাকমা (২১)। একই দিন বিকেলে দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) নামের একজন নিহত এবং ছয়জন আহত হন। ১৮ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মামুন নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার জের ধরে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে।

পরদিন বিকেলে দীঘিনালায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় শতাধিক দোকান। স্বনির্ভর এলাকায়ও দোকানপাটে হামলার আশঙ্কায় সেদিন রাতে হাজারখানেক পাহাড়ি ছাত্র-জনতা স্বনির্ভর সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন। মূলত নাশকতা ঠেকাতে গিয়ে তাঁরা হতাহত হন।

গতকাল বৃহস্পতিবার ও আগের দিন খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে কথা হয় নলেজ চাকমাসহ কয়েকজনের সঙ্গে। বুধবার হাসপাতাল থেকে তিনজন ছাড়া পেয়েছেন। এখন নলেজ ও বিজয়া চাকমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুজনেই সেদিনের ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা দেন। তাঁদের দাবি, সেদিন অতর্কিত তাঁদের ওপর গুলি করা হয়। 

প্যারাছড়া এলাকার বাসিন্দা নলেজ বলেন, গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল। সঙ্গে আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

পাশের শয্যায় রয়েছেন বিজয় চাকমা (৩২)। তিনিও রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। গুলিতে মারা যাওয়া রুবেল ত্রিপুরা তাঁর সঙ্গেই কাজ করতেন একই ঠিকাদারের অধীনে। তাঁরা একসঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন। বিজয়ের গুলি লাগে ডান পায়ে। 

কলেজছাত্র সোহেল চাকমার পায়ে গুলি লাগে। বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলে জানান। বুধবার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন পানছড়ি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র নান্টু চাকমা। তিনি ডান হাঁটুর নিচে গুলিবিদ্ধ হন।

গাছবান এলাকার বাসিন্দা নান্টু বলেন, ‘আমরা হাজারখানেক ছাত্র-জনতা সেখানে অবস্থান নিয়েছিলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে এভাবে গুলি করবে, আমরা ভাবতে পারিনি। একই সময় আমার বন্ধু বাবুধন চাকমাও গুলিবিদ্ধ হন। এখনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। আমাদের চোখের সামনে দুজন মারা গেলেন।’

সুস্থ হলেও আহতদের মধ্যে দীর্ঘদিন মানসিক ট্রমা কাজ করবে বলে মনে করছেন মানসিক উন্নয়ন কেন্দ্র উৎস-এর নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কামাল যাত্রা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা আহতদের মনে প্রভাব ফেলবে। একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি পার করে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের এই ট্রমা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।