সংসদ সদস্যদের টানাটানি, ছয় বছরে হয়নি একটি সারের গুদামও

  • ২০১৮ সালে ৩৪ জেলায় গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিসিআইসি।

  • ব্যয় ২,৪৮৩ কোটি টাকা।

  • কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন জেলায় গুদাম নির্মাণ করছে।

সারের গুদামপ্রতীকী ছবি

প্রয়োজনের সময় দ্রুত কৃষকের কাছে ইউরিয়া সার পৌঁছে দিতে ২০১৮ সালে দেশের ৩৪টি জেলায় গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি)। তবে গত প্রায় ছয় বছরে একটি গুদামেরও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ বাকি এক বছরেরও কম।

বিসিআইসি সূত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারের গুদাম কোন এলাকায়, তা নিয়ে সংসদ সদস্যের টানাটানি, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা ও বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের কারণে গুদাম নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, গুদাম নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্থান পরিবর্তনের চাপ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ধীরগতির একটি কারণ।

সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় গুদাম চান। জমি অধিগ্রহণ নিয়েও জটিলতা। বিসিআইসি নির্মাণকাজই শুরু করতে পারেনি।

বিসিআইসি বলছে, নতুন সারের গুদামগুলো নির্মিত হলে বাড়তি আট লাখ টন সার সংরক্ষণ করা যাবে। যথাসময়ে সার আমদানি করে মজুত করা যাবে। মৌসুমের সময় চাপ পড়বে না। এতে বছরে সরকারের ৬০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। কৃষকদেরও প্রয়োজনের সময় দ্রুত সার দেওয়া যাবে।

আইএমইডির প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারের গুদাম নির্মাণ নিয়ে পাশাপাশি সংসদীয় আসনগুলোর বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য চাপ তৈরি করেছিলেন। তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গুদাম চেয়েছিলেন। কোনো কোনো সংসদ সদস্য বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে তাঁর এলাকায় গুদামটি করা দরকার। কেউ আবার গুদাম নির্মাণের তদবির করতে নিজ আসনের ভালো যোগাযোগব্যবস্থার কথা বলেন।

সারের গুদাম কোথায় হবে, তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করা অন্তত পাঁচজন জনপ্রতিনিধির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। বিসিআইসির বরাদ্দ গুদাম নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দীন ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের মধ্যে। গুদামটি পবা উপজেলায় করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে তদবির করেছিলেন আয়েন উদ্দীন। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় গুদামটি চেয়েছিলেন মেয়র খায়রুজ্জামান। শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি পবা উপজেলার পক্ষে মত দিলেও এখনো গুদামের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।

সরকারি টাকায় জেলায় জেলায় গুদাম করার প্রয়োজন নেই। সরকারি পর্যায়ে গুদাম করা ব্যয়বহুল। জমি অধিগ্রহণে অনেক টাকা খরচ হয়।
শামসুল আলম, সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

স্থান নির্বাচন নিয়ে মেয়রের সঙ্গে এ দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করেছেন আয়েন উদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার কারণে সারের গুদামের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হবে পবা উপজেলা। এতে সেখানে কর্মসংস্থানও হবে। আর মেয়র যেখানে গুদাম নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি মূল রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে।

এ বিষয়ে খায়রুজ্জামান লিটন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাশিয়াডাঙ্গা এলাকাটা বেশ নিরিবিলি, সার কারখানার জন্য ভালো জায়গা। তাই একসময় আমি সেখানে চেয়েছি। পবার যেখানে এখন গুদাম হচ্ছে, সেটি বিমানবন্দর সড়কে। রাস্তায় যানবাহনের চাপ থাকে। পরে শুনেছি সেখানেই গুদাম হবে। বিষয়টি মেনে নিয়েছি। এরপর কেন কাজ হয়নি, সেটা জানা নেই।’

এদিকে নাটোর-৪ আসনের (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) সংসদ সদস্য প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস সারের গুদাম তাঁর নির্বাচনী এলাকা গুরুদাসপুর অথবা নাটোর সদরে করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে নাটোর-২ (সদর উপজেলা-নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম তদবির করেছিলেন নলডাঙ্গা উপজেলার জন্য। সেখানেও গুদামের কাজ শুরু হয়নি।

রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দীন ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের মধ্যে। গুদামটি পবা উপজেলায় করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে তদবির করেছিলেন আয়েন উদ্দীন। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় গুদামটি চেয়েছিলেন মেয়র খায়রুজ্জামান।

আবদুল কুদ্দুসের মৃত্যুর পর সারের গুদাম নলডাঙ্গায় নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তাঁর মেয়ে কোহেলী কুদ্দুস। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এই সদস্য গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, নলডাঙ্গার যোগাযোগ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো নয়। ফলে সেখানে গুদাম হলে কৃষকের কষ্ট বাড়বে। এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, সদর উপজেলায় আরও গুদাম থাকলেও নলডাঙ্গায় কিছুই নেই। তাই একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি জনগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে গুদাম করতে চেয়েছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আরও বেশ কয়েক জায়গায় সংসদ সদস্যদের টানাটানিতে গুদামের নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে আছে। বগুড়ায় প্রথমে গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় কাহালু উপজেলায়। যদিও বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান চেয়েছিলেন শাজাহানপুর উপজেলায়। সেখানেও গুদামের কাজ স্থবির হয়ে আছে।

নলডাঙ্গার যোগাযোগ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো নয়। ফলে সেখানে গুদাম হলে কৃষকের কষ্ট বাড়বে।
সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য কোহেলী কুদ্দুস

কুষ্টিয়ায়ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বে সারের গুদামের জন্য এখনো জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি। এ প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় একটি সারের গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের তদবিরে সেখানে গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় একটি সারের গুদাম রয়েছে জানিয়ে বিসিআইসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, কাজীপুরে গুদাম নির্মাণের খুব প্রয়োজন ছিল না। এ গুদামের নির্মাণকাজও এখনো শুরু হয়নি।

সারের গুদাম নির্মাণে এত দেরি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক মঞ্জুরুল হক গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে দেরি হচ্ছে। এখনো পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি। গুদাম নিয়ে সংসদ সদস্যদের টানাটানির বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছয় মাস আগে তিনি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে এসেছেন। তাই আগের অনেক কিছুই তাঁর অজানা।

সারের গুদাম কতটা দরকার

বিসিআইসির তথ্য বলছে, দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা বছরে ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে পাঁচটি সার কারখানা থেকে বছরে উৎপাদন হয় সাড়ে ৬ লাখ টন। আমদানি করা হয় গড়ে ১১ লাখ টনের মতো। এর বিপরীতে দেশের ৩২টি গুদামে সংরক্ষণ করা যায় মাত্র ৩ লাখ ৭১ হাজার টন।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এখন গাদাগাদি করে গুদামে সার রাখতে হয়। সব জেলায় গুদাম না থাকায় কৃষকদের সার পেতে দেরি হয়, খরচও বেশি হয়। এ সমস্যা সমাধানে ৪৭ জেলায় ইউরিয়া সারের গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৪৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩টি গুদামের নির্মাণকাজ চলছে। কাজ শেষ হলে সেখানে দেড় লাখ টন ইউরিয়া সার রাখা যাবে। আর ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকায় ৩৪টি গুদাম নির্মাণের প্রকল্প শেষ হলে আরও ৮ লাখ টন সার সংরক্ষণ করা যাবে।

শুধু বিসিআইসি নয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় সারা দেশে গুদাম নির্মাণ করছে। এর মধ্যে সারের গুদাম ছাড়াও রয়েছে পচনশীল পণ্য মজুতের জন্য গুদাম। যেমন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বিদ্যমান সার গুদাম রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসনে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে ব্যয় হচ্ছে ৩৫১ কোটি টাকা।

সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি টাকায় জেলায় জেলায় গুদাম করার প্রয়োজন নেই। সরকারি পর্যায়ে গুদাম করা ব্যয়বহুল। জমি অধিগ্রহণে অনেক টাকা খরচ হয়। ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। তাই পাটের গুদাম যেগুলো খালি পড়ে আছে, সরকার চাইলে সেগুলো কাজে লাগাতে পারে। তিনি বলেন, সরকার ব্যক্তি খাতও কাজে লাগাতে পারে। রেলের জমি পড়ে আছে, তা-ও ব্যবহার করা যেতে পারে।