রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে

ল' রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘কেমন সংবিধান চাই’ শীর্ষক আলোচনায় অতিথিরা। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ১৬ নভেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

নতুন সংবিধান হবে, নাকি সংবিধান সংশোধন হলেই কাজ হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য সংলাপ দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্র ঠিক থাকলে ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গেলে অন্য সব সমস্যার সমাধান হবে।

‘কেমন সংবিধান চাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় শনিবার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবী ও বিশিষ্টজনেরা এমন অভিমত তুলে ধরেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে আইন, বিচার, সংবিধান ও মানবাধিকারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল' রিপোর্টার্স ফোরাম।

সভায় সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরেন ল' রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি ও ইত্তেফাক–এর নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন। এতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করা হয়েছে। উচ্চকক্ষের নাম জাতীয় পরিষদ এবং নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ। প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন হবে ৩০০ আসনে। জাতীয় পরিষদের আসনসংখ্যা ২০০ হবে। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আইনসভার মেয়াদ হবে চার বছর, এমন প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়েছে।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে এখানে দাঁড়িয়ে সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে, এটা তাঁদের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা জানানো। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও চিন্তায় রাখতে হবে। কারণ, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে আছি বলে মনে হয়।’

সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই প্রস্তাবনাগুলো বর্তমান সরকারের জায়গা থেকে সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ বা প্রস্তাবনা নিতে পারবে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধ্যাদেশ আকারে সবকিছু করতে পারবে। শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া। সংসদ নেই এখন, গণভোটের বিধান নেই। গণভোট দিলে কীভাবে দেওয়া হবে—এ প্রশ্নগুলো যৌক্তিক ও আইনগতভাবে আসবে।

গণতন্ত্র ঠিক থাকলে ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গেলে অন্য সব সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে একটা জায়গা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে পাঁচ বছর পরপর জনগণ তার স্বাধীন, সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। সেই সংবিধানে বাংলাদেশের মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু সেখানে যদি গরমিল থাকে, সেখানে যদি নিশ্চয়তা প্রদান না করা হয়, যতভাবে প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজান না কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানই ঠিক ওইভাবে কাজ করবে না, যেমন কাজ করেনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখেছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একমাত্র পথ হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষমতা ভোটাধিকারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা।’

অতীতে একাধিক সংশোধনীর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা আগে হয়েছে, তারপর কার্যকর হয়েছে বলে সভায় উল্লেখ করেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন। তিনি বলেন, যত কমিশনই হোক না কেন, চূড়ান্তভাবে জনগণের কাছেই যেতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে জনগণ। বিচারক নিয়োগ করার জন্য সংসদের আইন করার কথা ছিল। ৫৩ বছর চলে গেলেও আইন হয়নি। এটা করতেই হবে। যথার্থ আইন থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো ইচ্ছেমতো তাদের লোক নিয়োগ দিতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন আইন হলেও তা অসম্পূর্ণ। পরিপূর্ণ আইন করা দরকার, যাতে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।

তত্ত্বাধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়েও কথা বলেন এম এ মতিন। তিনি বলেন, ‘যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আসে, তাতে কিছু সংশোধন লাগবে। কোনো রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দেখতে চাই না। বিচার বিভাগের কাউকেও সেখানে রাখার দরকার নেই।’

সংবিধান পুনর্লিখিত হবে, নাকি নতুন করে হবে, তা জনগণের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন এম এ মতিন। তিনি বলেন, ‘যাঁরা হতাহত হলেন, তাঁদের চাওয়া–পাওয়া সন্নিবেশিত করে একটা সংলাপ করা যেতে পারে। সংলাপের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমঝোতা ও সে অনুযায়ী নির্বাচন করে যারা আসবে, তারা এদের (অন্তর্বর্তী সরকার) কাজটা অনুমোদন করবে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। ঐতিহ্য আছে। তবে প্রয়োজন হবে ঐকমত্য, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা।’

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধানে অনেকগুলো পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, সংবিধানকে নষ্ট করা হয়েছে সংশোধনীর মাধ্যমে। বড় নষ্ট করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। অনেকের ধারণা, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসবে। যতটুকু বুঝি ফিরে আসবে না, এ জন্য সংসদের ভূমিকা লাগবে। বিল আকারে উত্থাপন ও অনুমোদন করতে হবে।’ বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নিশ্চিতের ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি।

গত ৫৩ বছরে বিভিন্ন সময় সংবিধান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে পারেনি, বরং রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করেন সাংবাদিক কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটার যে প্রক্রিয়া থাকার কথা, সেটি কাজ করেনি। সংবিধান ব্যর্থ হয়েছে।

সংবিধানের ত্রুটি দূর করার উপায় সম্পর্কে কামাল আহমেদ বলেন, ‘নাগরিকের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। সংসদ সদস্যদের জবাবদিহির ব্যবস্থাটা থাকতে হবে। জবাবদিহির ব্যবস্থা যতক্ষণ না করতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের প্রজা হয়েই থাকব।’

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করা না গেলে কোনো কিছুই কাজ করবে না বলে মনে করেন কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অবশ্যই তুলে দিতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদে শুধু আস্থা ভোট ছাড়া এমনকি অর্থবিলের প্রশ্নেও সংসদ সদস্যকে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে নতুন সংবিধান হবে, নাকি সংশোধনী হলেই কাজ হবে। আশা করব, সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানোর উদ্যোগ এই সরকার নিতে পারে।’

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, ‘যে সংবিধানটা পেয়েছিলাম, সেই সংবিধানকে বারবার ব্যক্তিস্বার্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংশোধন করা হয়েছে, জনস্বার্থে নয়। জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। যে প্রেক্ষাপটে আজকে পরিবর্তন এসেছে, বিজ্ঞজন, সাংবাদিকদের উচিত এই পরিবেশে জনমত সৃষ্টি করা।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে বেরোতে হলে, একনায়ক বা একনায়িকাতন্ত্র থেকে বেরোতে হলে গণতন্ত্রের পক্ষে যদি এগোতে হয়, অবশ্যই সংবিধানের কিছু কিছু জায়গায় জরুরি পরিবর্তন প্রয়োজন। তার সঙ্গে মৌলিক মানবাধিকারও প্রতিষ্ঠা করতে হবে,  সে জন্যও কিছু সংশোধন নিয়ে আসতে হবে।’

এই মুহূর্তে সংবিধান পুনর্লিখন সম্ভব নয় বলে মত দেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রক্রিয়া সংবিধানে নেই। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু কিছু সংশোধন হতে পারে। আন্দোলনের নাম ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্য কীভাবে নিরসন করতে পারব, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’ ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যাওয়া উচিত হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘ভবিষ্যতের সংবিধান হওয়া উচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক, বাংলাদেশের পাহাড়ি, আদিবাসীসহ সাংস্কৃতিক ভাষাগত ইত্যাদি বহুমাত্রিকতা যাতে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে শুরু করে বরেন্দ্রভূমি…পুরোপুরি যাতে সম্পৃক্ত হয়—এসব অঞ্চলের মানুষ সত্যিকার যাতে মনে–প্রাণে গর্ব নিয়ে বাংলাদেশি মনে করে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘৫৩ বছরে ভালো নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। এমন কোনো ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি যে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সরকার পরিবর্তন করা যাবে। বরং সরকার বদল করার যখন প্রশ্ন আসছে, তখন অসাংবিধানিক কোনো পদ্ধতির প্রয়োজন হয়েছে। এর একটা সমাধান মানুষ চায়। বিচার বিভাগের ও বিচারিক পদ্ধতির সংস্কারে মানুষের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।’

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন। তিনি বলেন, সংবিধানে আছে ন্যায়পাল হবে। ন্যায়পাল আমরা কোনো দিনও দেখলাম না। ন্যায়পাল থাকলে হয়তো আমরা কিছুটা শান্তি পেতাম। যাহোক, সংসদ সদস্যদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। পিয়নের চাকরি নিতে গেলেও অষ্টম শ্রেণি পাস লাগে। অন্তত আইনগুলো কী হচ্ছে, সে সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা দরকার। শুধু হাত তোলা দিয়ে হবে না, তার অংশগ্রহণ দরকার হতে পারে এবং হওয়া উচিত। ছাত্র-জনতা যা এনে দিয়েছে, তা সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এসব আলোচনা হচ্ছে। উচিত হবে এটি বজায় রাখা। আর রাজনৈতিক সমঝোতা আমাদের মধ্যে হবে কি না, তা নিয়ে খুব সন্দেহ আছে। যদি হয় তো ভালো। এতে যদি দেশের উন্নতি হয়, দেশ যদি একত্রে অগ্রসর হতে পারে, মনে হয় ভালো হয়।

ল' রিপোর্টার্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদের সঞ্চালনায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম ও মুস্তাফিজুর রহমান খান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ও আইন শিক্ষক সাইমী ওয়াদুদ বক্তব্য দেন। আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন ল' রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন।