স্তন ক্যানসার শনাক্তে তিন বছরে একবার ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করা জরুরি
স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। যেখানে অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অদিতি পাল চৌধুরী এবং ডা. রুবামা করিম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন নাসিহা তাহসিন।
বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার কী, এর লক্ষণ কী কী, কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, ডায়াগনোসিসের বিভিন্ন উপায়, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন অতিথিরা। গত ২৬ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান ক্যানসার কী? উত্তরে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের শরীরে কোষগুলো স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হয়, যা একসময় থেমে যায়; কিন্তু কোষগুলো যখন অপ্রতিরোধ্যভাবে বাড়তে থাকবে, থামবে না, তখন এটাকে ক্যানসার বলে। কোষের এ অস্বাভাবিক পরিবর্তন যখন স্তনে হয়, এটাকে বলে স্তন ক্যানসার।’
‘সুনির্দিষ্ট বয়সের পর কারও যদি স্তনে ব্যথাহীন গোটা, বগলের নিচে কোনো ব্যথাহীন চাকা, স্তনের স্কিন বা চামড়া দেবে যাওয়া, লালচে রং ধারণ করা, ঘা হয়ে যাওয়া, হাড়ে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি স্তন ক্যানসারের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ।’ডা. রুবামা করিম
স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. রুবামা করিম বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টর দুই ধরনের—মোডিফায়েবল ও ননমোডিফায়েবল। নন-মোডিফায়েবল মানে হলো যেগুলোতে কিছুই করার থাকে না। যেমন বয়স বৃদ্ধি হওয়া, নারী হিসেবে জন্ম নেওয়া, ৫৫ বছর বয়সী নারী যাঁর মাসিক একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে বা ‘‘মেনোপজ’’ হয়েছে, যে নারী নিঃসন্তান, ৩৫ বছর বয়সী নারী, যাঁর পূর্ণ গর্ভকাল বা ফুলটাইম প্রেগন্যান্সি হয়েছে, বংশের কারও যদি ক্যানসার থাকে, জেনেটিক মিউটেশন থাকা—এ ধরনের নারীদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। আর মডিফায়েবল বা যেটাতে কিছু করার থাকে, সেগুলো হলো অ্যালকোহল বা তামাক গ্রহণ করা, কায়িক শ্রম না করা, পোস্ট মেনোপজাল হরমোন থেরাপি যাঁরা নেন, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খান—তাঁদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।’
স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট বয়সের পর কারও যদি স্তনে ব্যথাহীন গোটা, বগলের নিচে কোনো ব্যথাহীন চাকা, স্তনের স্কিন বা চামড়া দেবে যাওয়া, লালচে রং ধারণ করা, ঘা হয়ে যাওয়া, হাড়ে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি স্তন ক্যানসারের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ।’
স্ক্রিনিং কী এবং ক্যানসার শনাক্তকরণে এর গুরুত্ব কতটুকু? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. রুবামা করিম বলেন, ‘স্ক্রিনিং মানে হলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্তকরণ। এটি কয়েক ধরনের রয়েছে। প্রথমত সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়সের পর একজন নারী নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। যেটা ২০ বছর পর থেকে একজন নারী করবেন। এ সময় অস্বাভাবিক কিছু পেলে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। সেখানে তাঁর ক্লিনিক্যাল এক্সামের পর চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রাম করবেন। তারপর মেমোগ্রাফি বা মেমোগ্রাম করবেন।’
রোগীর ক্যানসার কোন পর্যায়ে আছে তার ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসাপদ্ধতি। এটা তিন ধরনের—আর্লি, লোকালি অ্যাডভান্স এবং অ্যাডভান্স স্টেজ।
এ প্রসঙ্গে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী আরও বলেন, ‘সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করতে হয় ২০ বছর বয়সী মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়ার দুই দিন পর। তবে যাঁদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁদের ক্ষেত্রে মাসের যেকোনো এক দিন করাতে পারে। ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে প্রতি ৩ বছরে অন্তত একবার ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করাতে হয়। ৪০ বছর পার হওয়ার পর প্রতি এক বছর পর এটি পরীক্ষা করা উচিত।’
এরপর উপস্থাপক জানতে চান মেমোগ্রাম কী এবং এটি কখন করাতে হয়? উত্তরে ডা. রুবামা করিম বলেন, ‘মেমোগ্রাম একটি এক্স-রে। এটি করাতে হয় ৪০ বছর বয়স পার হওয়ার পর প্রতিবছরে একবার।’
স্তন ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘কোর বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের শ্রেণি বিভাজন করা হয়। যা সাধারণত চার প্রকার—লুমিনাল এ, লুমিনাল বি, হার-টু পজিটিভ এবং থ্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার।’
এরপর স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার ধরন ও ধাপ সম্পর্কে ডা. রুবামা করিম বলেন, ‘ক্যানসারের চিকিৎসা করার আগে এর ধাপ ও ধরন সম্পর্কে জানা জরুরি। এর ওপর নির্ভর করবে কোন চিকিৎসা দিয়ে প্রথম শুরু করতে হবে। যেমন ‘‘থ্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’’-এর ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। মূলত মাল্টি ডিসিপ্লিনারি যে বোর্ড রয়েছে, সেখানকার বিশেষজ্ঞরাই চূড়ান্ত চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করেন।’
উপস্থাপক জানতে চান কীসের ওপর চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ভর করে? উত্তরে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘রোগীর ক্যানসার কোন পর্যায়ে আছে তার ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসাপদ্ধতি। এটা তিন ধরনের—আর্লি, লোকালি অ্যাডভান্স এবং অ্যাডভান্স স্টেজ। এ ছাড়া নির্ভর করে টিউমারের সাইজ কেমন, ক্যানসারের রেট, ইআরপিআর স্ট্যাটাস, রোগীর শারীরিক অবস্থা ইত্যাদি।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নারীরা ব্রোটক্স ও সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট গ্রহণ করে থাকেন, সেগুলোতে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কতটুকু?
এ প্রসঙ্গে ডা. রুবামা করিম বলেন, ‘ব্রোটক্স স্তন ক্যানসারে কোনো ঝুঁকি তৈরি করে না; আর সিলিকন ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে কোনো ঝুঁকি এখনো প্রমাণিত হয়নি; কিন্তু অনেক দিন সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট থাকার কারণে স্তনের আশপাশের যে টিস্যু, সেগুলোতে লিম্ফোমা তৈরি হতে পারে। তবে এটির সম্ভাবনা ক্ষীণ।’
স্তন ক্যানসার রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যে কী কী প্রভাব ফেলে? এ বিষয়ে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, ‘স্তন ক্যানসার রোগীরা মানসিক অবসাদে ভোগেন। তবে তাঁদের উচিত চিকিৎসকের সঙ্গে শেয়ার করা।’
একজন দর্শক প্রশ্ন করেন, যাঁদের বিদেশে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁরা কীভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন? উত্তরে ডা. রুবামা করিম বলেন, ‘দেশেই ক্যানসারের চিকিৎসা হচ্ছে। আর হাসপাতাল-ওষুধও পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। পাশাপাশি ওষুধের দামও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের দেশে চিকিৎসাপদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানের। তাই বিদেশে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।’