ইফতারে শরবতের বাহার
প্রতিদিনের ইফতারের টেবিলে রকমারি যত পদই থাকুক না কেন, প্রথমেই হাত যায় হিমশীতল শরবতের গ্লাসে। চুমুকেই আসে প্রশান্তি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরবতেও এসেছে বৈচিত্র্য। সাধারণ গুড় বা লেবু, চিনি, পানির শরবতের কদর কমেছে। নতুন প্রজন্মের পছন্দ এখন নানা ধরনের স্মুদি, মকটেল, পেস্তাবাদাম, চিয়া সিড, মোহিত। তাঁদের সঙ্গে পা মিলিয়ে পুরোনো প্রজন্মও এসবের স্বাদ নেন।
ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই শরবতের জগৎ এখন বৈচিত্র্যময়। শুধু বৈচিত্র্যময়ই নয়, সৌন্দর্যময়। নানা রঙের শেডে বানানো শরবত, তাতে ফুল, পাতা, লেবুর টুকরা দিয়ে বাহারি সাজ দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। শরবতের স্বাদও এখন কেবল মিষ্টি নয়; আছে টক, ঝাল—এমনকি কিছুটা তিতকুটে স্বাদের শরবতও। লেবুর দাম চড়া হওয়ায় বিটরুট আর তেঁতুলের শরবতও জায়গা করে নিয়েছে ইফতারের টেবিলে। বাঙ্গি বা তরমুজও পিছিয়ে নেই।
সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজ দেখে ও কথা বলে জানা গেল হরেক রকমের শরবতের খবর।
বাহারি সব সাজ ও ভিন্ন স্বাদের শরবত বেশি পাওয়া যায় ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানীতে। গুলশান–১ নম্বরে ‘স্মিথস’রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় অরেঞ্জ সানসেট। হালকা কমলা আর লালের মিশেলে বানানো এই শরবতের শেড। অনেকটা গোধূলির রঙে মাখা। শরবত তৈরিতে নিচে দেওয়া হয় লাল সিরাপ। ওপরে মাল্টার রস। টক–মিষ্টি স্বাদের এই অরেঞ্জ সানসেটের দাম ২৫০ টাকা।
হাল আমলের আরেক শরবত ‘পাইনঅ্যাপল এক্সপ্রেস’। গুলশানের ‘ফার্ম হাউস’রেস্তোরাঁর এই শরবত থাকে বরফকুচিতে ভরা। এমনকি আনারসের বরফের কিউবও ব্যবহার করা হয় এতে। চুমুক দিলেই শীতলতা।
গুলশানে আরেক আকর্ষণীয় শরবত অ্যাভোকাডো কোকোনাটের স্বাদ পাওয়া যাবে ‘হ্যাপি টি’ রেস্তোরাঁয়। চায়নিজ নারকেলের দুধ আর অ্যাভোকাডোর মিশেলে বানানো হয় এই শরবত। তবে এই শরবত বেশ দামি। ৭০০ এমএল শরবতের দাম পড়বে ৭৮০ টাকা।
এসব টক-ঝাল শরবত থেকে মন ফেরাতে চাইলে বাদাম ও জাফরানের মিশেলে বানানো শরবত–ই–জান্নাতের স্বাদ নেওয়া যায়। এই শরবত পাওয়া যাবে বনানীর ১২ নম্বর সড়কে ‘ঢাকাইয়া পাক্কি’-তে। ধানমন্ডির ‘সুলতানস ডাইন’-এও রয়েছে বাদামের শরবত।
যাঁরা শরবত হিসেবে মোহিত পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য ধানমন্ডি ৬ নম্বরের ‘পাইনউডে’ রয়েছে স্ট্রবেরি, ওসান ব্লু ও ভারজিন মোহিত। স্ট্রবেরির টক–মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে স্প্রাইটের ঝাঁজালো স্বাদের মিশেলে বানানো হয় এই মোহিত। ওশান ব্লুর গ্লাসে রয়েছে নীলাভ সাগরের ছোঁয়া। স্বাদ মিষ্টি ও ঝাঁজালো।
এ ধরনের ট্রেন্ডি শরবত অবশ্য পাওয়া যায় বসুন্ধরা সিটিতেও। ১১ মার্চ সেখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে শরবতের পসরা নিয়ে বসে রয়েছে ‘ফরমোসা কিউকিউটি’। এখানে পাওয়া যায় পেঁপে, স্ট্রবেরি, চকলেট, মিক্সড ফ্রুট, গ্রিন ম্যাঙ্গো, তরমুজের স্মুদি। সব কটিতেই ফলের সঙ্গে রয়েছে আইসক্রিম। দাম ২৪০ টাকার মধ্যে।
যাঁরা আরেকটু কম দামে ফলের শরবত চান, তাঁদের জন্য রয়েছে বসুন্ধরার পেছনে রাস্তার ধারে কিছু শরবতের দোকান। সেখানেও রয়েছে তরমুজ, বেল, দই, আখের শরবত।
এ তো গেল হাল আমলের শরবতের কথা। যাঁরা সাবেকি শরবত পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য দই, বাদাম আর জাফরানের মিশেলে শরবত পাওয়া যায় নানা জায়গায়। কলাবাগানে ‘বাবুমশাই হেরিটেজ’ রেস্তোরাঁয় মিলবে এ রকম নানা লাচ্ছি। ধানমন্ডিতে ‘কাচ্চি ভাই’–এ রয়েছে বাদামের শরবত। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে পেস্তা আর জাফরানের মিশেলে পাওয়া যায় ‘মুম্বাই এক্সপ্রেস’ শরবত।
আর ঘরোয়া স্বাদে নতুন ধরনের শরবতের স্বাদ পেতে ঢুঁ দিতে পারেন পান্থপথের ‘মাদল খাবারঘর’ বা ধানমন্ডির ‘এনস কিচেনে’। পান্থপথের মাদলে পাওয়া যাবে লেবু, পুদিনা, তোকমা, চিয়া সিড, পেস্তাবাদাম, মাঠা, লাচ্ছি, তাজা ফলের শরবত। এখানে পাওয়া যায় ডাবের পানি আর শাঁস দিয়ে বানানো ‘ডাব মালাই’। মাদল খাবারঘরের উদ্যোক্তা মাসুমা খাতুন বললেন, এবারের পবিত্র রমজানে তাঁদের বানানো প্রায় সব ধরনের শরবতেরই চাহিদা রয়েছে। এখান থেকে প্রায়ই ইফতারি কেনেন বেসরকারি কর্মজীবী নারী আফরোজা বেগম। তিনি বললেন, শরবতের মধ্যে তাঁর বেশি পছন্দ পুদিনার শরবত।
যাঁরা কেবল তাজা ফলের রস পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য রয়েছে ‘এনস কিচেন’। ধানমন্ডি ৯/এ–তে এই এনস কিচেনে পাওয়া যায় মিন্ট লেমোনেড, পেঁপে, কমলা, ইসবগুল, কাঁচা আম, তরমুজের শরবত। মাল্টা, লেবু, ফুল, পুদিনা, ধনেপাতা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হিমশীতল শরবত পাওয়া যায় এখানে। দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।
তবে সবশেষে যে শরবতের কথা না বললেই নয়, তা হলো পুরান ঢাকার শাহি সব শরবত। লালবাগ কেল্লার পাশেই প্রায় ১৭ বছর ধরে মোগল কায়দায় পেস্তাবাদামের শরবত বানাচ্ছে ‘রয়্যাল হোটেল’। আর জনসন রোডের ‘বিউটি লাচ্ছি’র জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি আজও। দই, চিনি, বরফ, লেবু মিশিয়ে আরও কিছু বিশেষ উপাদান দিয়ে বানানো হয় এই শরবত। সুরিটোলা স্কুলের উল্টো দিকে পাওয়া যায় ‘দিলবাহার আজওয়া’ শরবত। দুই থেকে তিন লেয়ারে মালাই দই, চকলেট, কাজুবাদাম দিয়ে বানানো এই শরবত পেতে লাইনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়।