রোহিঙ্গা শিবিরে চাঁদাবাজি–নির্যাতন করছে এপিবিএন: এইচআরডব্লিউ
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা রোহিঙ্গাদের থেকে চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারীভাবে তাদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। আজ মঙ্গলবার এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ করা হয়েছে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে নিপীড়নের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করতে দাতা দেশগুলোর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোয় মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় আশ্রয়শিবিরে রয়েছে এপিবিএনের ক্যাম্প। এপিবিএন বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ একটি শাখা।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পায় এপিবিএন। সেখানকার শরণার্থী ও মানবিক সহায়তাকর্মীরা জানিয়েছেন, এপিবিএন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এটা হয়েছে ক্রমে পুলিশের নিপীড়ন বাড়তে থাকা এবং শিবিরে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে। এপিবিএন কর্মকর্তা, সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করছেন বলে কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন।
কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে পুলিশের যে বাহিনীর রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার কথা, রোহিঙ্গারা তাদের হাতেই অন্যায় অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন
এ বিষয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়াবিষয়ক গবেষক শায়না বাউকনার বলেন, ‘কক্সবাজার আশ্রয়শিবিরে পুলিশের নিপীড়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এমন এক দুর্দশায় ফেলেছে যে যাঁদের তাদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা তাদের হাতেই তারা আক্রান্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন কর্মকর্তাদের ব্যাপক পরিসরে চাঁদাবাজি ও ভুল আটকের অভিযোগগুলোর তদন্ত করা এবং দায়ী প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে এপিবিএনের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ওপর গুরুতর নির্যাতন ও হয়রানির অন্তত ১৬টি ঘটনা তাদের নজরে এসেছে। এ বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাদের কাছে ঘুষ দাবি করেছেন। ঘুষ দিতে না পারলে আটকের হুমকিও দিয়েছেন। আশ্রয়শিবিরে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে, এপিবিএনের হাতে অন্যায়ভাবে আটক হওয়া স্বজনদের ছাড়াতে স্বর্ণালংকার বিক্রি কিংবা অর্থ ধার করতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
প্রতিবেদনের তথ্য, এপিবিএনের সদস্যরা আটক হওয়া এড়াতে একেকজনের কাছে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা (১০০–৪০০ ডলার) দাবি করেন। আর আটক কাউকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁদের দাবি, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা (৫০০–১০০০ ডলার)।
প্রতিবেদনের তথ্য, এপিবিএনের সদস্যরা আটক হওয়া এড়াতে একেকজনের কাছে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা (১০০–৪০০ ডলার) দাবি করেন। আর আটক কাউকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁদের দাবি, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা (৫০০–১০০০ ডলার)।
স্থানীয় রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, আশ্রয়শিবিরে এপিবিএন সদস্যদের চাঁদাবাজি, হয়রানি, নির্যাতন ‘ব্যাপক হারে’ বেড়েছে। আলী জাকের নামের ২০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা জানান, তাঁর ভাই অসুস্থ ছিল। কয়েকদিন আগের তিনি ভাইয়ের চিকিৎসা প্রতিবেদন নিয়ে হাসপাতাল থেকে আশ্রয়শিবিরে ফিরছিলেন। চেকপোস্টে এপিবিএনের এক সদস্য তাঁকে আটকে দেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাঁকে চড় মারেন ওই সদস্য।
আলী জাকের বলেন, ‘ওই সময় এপিবিএনের সদস্যরা আমার কাছ থেকে প্রায় ৫০ ডলার ও মুঠোফোন রেখে দেন। এমনকি এ ঘটনা কাউকে বললে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন।’
৪৫ বছরের সিতারা বিবি বলেন, ‘আশ্রয়শিবিরে পুলিশের ঘুষ নেওয়ার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে।’ সিতারা বিবি জানান, তিনি তাঁর ছেলের বিয়ের সময় এপিবিএন সদস্যদের ৩ হাজার টাকা (৩০ ডলার) ঘুষ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা এ অর্থ তাঁদের না দিতাম, তাহলে তাঁরা আমার ছেলের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের মিথ্যা মামলা দিতো।’
গত ২২ নভেম্বর ৫৭ বছরের সায়েদুল হককে আটক করে এপিবিএনের সদস্যরা। পান বিক্রেতা সায়েদুলকে মুক্তি দিতে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে ১ লাখ টাকা (১ হাজার ডলার) চাওয়া হয়। সায়েদুলের মেয়ে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আয় কম। তাই আমরা পুলিশকে কোনো টাকা দিতে পারিনি।’ পরিবারের অভিযোগ, টাকা দিতে না পারায় বৃদ্ধ সায়েদুলের বিরুদ্ধে ২ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি রাখার অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। এখন তিনি জেলে আছেন।
আশ্রয়শিবিরের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে একজন স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা এএফপিকে বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ। এক আশ্রয়শিবির থেকে অন্য আশ্রয়শিবিরে যেতে, এমনকি রাতের বেলায় আশ্রয়শিবিরে ঢুকতে গেলেও রোহিঙ্গাদের চাঁদা দিতে হয়। যদি কেউ প্রতিবাদ করেন, তবে অত্যাচার–নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে। অন্যায়ভাবে আটক করা হয়।’
গুরুতর এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করতে ও অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শায়না বাইচনার। তাঁর মতে, প্রতিটি আশ্রয়শিবিরে এবিপিএনের সদস্য নয় এমন নিরাপত্তা কমর্কতাদের এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া উচিত, যাতে স্থানীয় রোহিঙ্গারা তাঁদের কাছে এসব অভিযোগ জানাতে পারেন।
শায়না বাইচনার আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ দাতাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে চাপ দিতে হবে।
তবে এপিবিএনের কমান্ডার সৈয়দ হারুন–উর–রশিদ এএফপিকে বলেছেন, এইচআরডব্লিউর এই প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর মতে, অপরাধীরা মানবাধিকার সংগঠনটিকে ভুল তথ্যউপাত্ত দিয়েছে। আর এসবের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেছে এইচআরডব্লিউ। এই প্রতিবেদন অপরাধীদের সুবিধা দেবে।
তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সেটা তদন্ত করে দেখা হবে বলেও জানিয়েছেন এপিবিএনের এই কর্মকর্তা।
পুলিশে ভাষ্য, কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোয় সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে গেছে। বিভিন্ন সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর আস্তানা হয়েছে। এমনকি আঞ্চলিক মাদক পাচারকারীরা আশ্রয়শিবিরকে তাদের নেটওয়ার্ক হিসেবে ব্যবহার করছে। আশ্রয়শিবিরের অন্তত ২০ রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। এ তালিকায় রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতাও রয়েছেন। সেইসঙ্গে আশ্রয়শিবিরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।