দেয়ালে একটি পারিবারিক ছবির ফ্রেমে চোখ আটকে যাচ্ছে। ছবিতে বাবার কোলে বসে আছে স্পৃহা। পাশে মা প্রিয়াঙ্কা। সম্ভবত স্পৃহার দ্বিতীয় জন্মদিনে তোলা। স্পৃহার বয়স এখন চার বছর। ভারতে তীর্থে যাওয়া বাবার পথ চেয়ে আছে সে। আর তার দাদুর সঙ্গে খুনসুটি করছে। শনিবার সকালে স্পৃহা দাদু স্বপন নাথকে বলছিল, ‘জানো আমার বাবা আমার জন্য এত্তগুলো খেলনা আনবে। তোমাকে দেব না।’
আজ রোববার নাতনির কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী স্বপন কুমার নাথ। স্বপন নাথের ছেলে অনিন্দ্য কৌশল, স্পৃহার বাবা। শনিবার ভারতের কাশ্মীরের ডাল লেকে হাউসবোটে অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা যান রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অনিন্দ্য কৌশলসহ (৩৬) তিনজন। অপর দুজন হলেন খাগড়াছড়ি গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ইমন দাশগুপ্ত (৩৪) ও ঠিকাদার মাইনুদ্দিন।
কাশ্মীরে ভোরের এই দুর্ঘটনার খবর পেতে পরিবারের লোকজনের সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এখন সবাই জেনে গেছেন এই তিনজন নেই। কেবল বুঝে উঠতে পারছে না ছোট্ট স্পৃহা। ঘরে শনিবার রাত থেকে কেন এত মানুষ আসছে, কেনই–বা মা, দাদু দিদি কাঁদছে, তা–ও বুঝতে পারছে না ছোট্ট মেয়েটি। অন্যের কান্না দেখে কখনো নিজেও কাঁদছে। আবার কখনো জানতে চাচ্ছে বাবা কখন ফিরবে?
স্পৃহার ছোট ভাইটির বয়স ১৫ মাস। তার নাম আরাধ্য। এ বছরের ১০ মে স্পৃহার চতুর্থ জন্মদিনের একটা ছবিতে দেখা যায় আরাধ্য মায়ের কোলে বসা। আর স্পৃহা যথারীতি বাবাভক্ত। এই শোক আরাধ্যকে ছুঁইনি। সে এই কোল ওই কোল ঘুরছে।
দুপুরে অনিন্দ্যদের জামালখানের বাসায় গিয়ে দেখা যায় শোকে মূহ্যমান পরিবারের সবাই। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব দেখলেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বাবা স্বপন নাথ।
স্বপন নাথ বলেন, ‘আমার ছেলে বলছিল, বাবা আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। একটু রিল্যাক্স করে আসি। আমি তাকে বললাম, বাবা একা যেয়ো না। তখন সে ইমন ও মাইনুদ্দিনের কথা বলল। জিও (সরকারি অনুমতি) পেতেও সময় লেগেছে। বাধা পেয়েছে সেখানেও। আহা বাধাটা যদি মানত।’
৩ নভেম্বর তাঁরা তিনজন ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। এরপর জয়পুর, দিল্লি, আজমির শরিফ, আগ্রাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। শুক্রবার তাঁরা পা রাখেন শ্রীনগরে। সেখানে ওই দিন বিকেলে ওঠেন ডাল লেকের একটি হাউসবোটে। তবে বোটটি তাঁদের পছন্দ হয়নি বলে শুক্রবারই জানিয়েছিলেন স্বজনদের।
স্বপন নাথ বলেন, ‘আমার ভাগনের সঙ্গে ছেলের খুব ভাব। সে তাকে ফোনে বলেছে, কাশ্মীর পৌঁছেছে। এরপর রাতে তার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলে। বোটটি পছন্দ হয়নি বলে জানায়। সকালেই ওখান থেকে একটা ভালো হোটেলে চলে যাবে বলে জানায় সে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।’
অনিন্দ্যের মা উমা নাথ শনিবার রাত থেকে থেমে থেমে কাঁদছেন। তিনি ক্লান্ত–শ্রান্ত। তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে অনিন্দ্য ছিল বড়। মেয়ে তূর্ণা কানাডাপ্রবাসী। এখন দেশে আছেন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) পড়াশোনা করেছেন অনিন্দ্য কৌশল। তিনি ৩০তম বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর বাড়ি মিরসরাইয়ে। মাঈনুদ্দিন ও ইমনের বাড়ি রাউজানে। ৩৩তম বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া ইমনের একটা মেয়ে রয়েছে। মাঈনুদ্দিনের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
শনিবার তাঁদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তিন পরিবারেই চলছে শোকের মাতম। ইমনের স্ত্রী রাঙামাটি পুলিশ সুপার কার্যালয়ের এএসপি লোপামুদ্রা মহাজন। তিনিও গতকাল রোববার সকালে অনিন্দ্যের জামালখানের বাসায় এসেছিলেন স্বামীর সর্বশেষ খবর এবং করণীয় সম্পর্কে জানতে।
স্বপন নাথ বলেন, ‘ইমনের স্ত্রী এসেছিল। আমার মনে হয় না মরদেহগুলো আনার মতো পরিস্থিতি আছে। এক আত্মীয়কে শ্রীনগর পাঠিয়েছি। আমি সোনার ছেলে হারিয়ে ফেললাম।’
আর অনিন্দ্যের স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা কী হারালেন, সেটা তিনি ছাড়া আর কে ভালো বুঝবেন। শুক্রবার রাতে স্বামীর সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। এর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই শনিবার সন্ধ্যায় নিশ্চিত হয়ে যান অনিন্দ্য আর ফিরবেন না। আগামী মাসে পৃথিবীর আলো দেখতে যাওয়া তাঁদের তৃতীয় সন্তানটি কোনো দিনই বাবার দেখা পাবে না।