সর্বোচ্চ আদালতের রায়, তবু দায় মেটাচ্ছে না রেল
২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে রায় দেন।
২০১৫ সালের ৮ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।
১৯ বছর আগের মামলা। বিচার শেষে চূড়ান্ত রায় হয় আট বছর আগে। কিন্তু রায় বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না দেখে বাদীপক্ষ আবার উচ্চ আদালতে যান। এবার আদালত রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে নির্দেশনা দেন। তা–ও পাঁচ বছর আগের কথা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সেই রায় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
উল্লিখিত মামলাটি বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়ন’ সদস্যদের। জাতীয় বেতন স্কেলে বৈষম্যের শিকার দাবি করা এই কর্মচারীরা উচ্চ আদালতে নিজেদের পক্ষে রায় পেয়েছেন।
আমাদের পাওনা না দিলে রেল বলুক যে তোমরা টাকা পাবা না। কিন্তু পাওনা টাকার জন্য জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এভাবে হয়রানি এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে এ রকম তামাশার কোনো অর্থ হয় না।সৈয়দ আহমদ, সাবেক স্টেশনমাস্টার
নথিপত্রের তথ্য বলছে, আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আইন, বিচার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পাঁচ বছর ধরে রায় নিয়ে মতামত আহ্বান ও পর্যালোচনাই করছে। বৈষম্যের শিকার কর্মচারীরা তাঁদের পাওয়া বুঝে পাচ্ছেন না।
মামলায় স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের দাবি ছিল, ১৯৭৭ সালের দ্বিতীয় জাতীয় বেতন স্কেলে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাঁরা। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় বেতন স্কেলে স্টেশনমাস্টারদের বেতন স্কেল এক ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালের বেতন স্কেলে স্টেশনমাস্টারদের স্কেল দুই ধাপ নিচে নির্ধারণ করা হয়।
এ মামলায় রেলওয়ের আইনজীবী সাহেদ আলম পাওনা পরিশোধের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেন। এরপর রায় বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে মামলায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা এবং তাঁর আর্থিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। হিসাবে দেখা যায়, রায়ে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ হাজার ২০৪ জন। এ জন্য ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে ৭০ কোটি ১৫ লাখ বরাদ্দ করা হয়।
রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে পাঁচ বছর আগে নির্দেশ দেন আদালত। এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সাহেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মামলা তো অনেক আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এখনো বেতন-ভাতা কেন পরিশোধ হয়নি, তা আমার বোধগম্য নয়।’
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্যরা প্রায় ২৮ বছর ধরে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের পাশাপাশি এর সমাধানে নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেন। ব্যর্থ হয়ে ২০০৫ সালের ২২ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি মোকলেছুর রহমানসহ পাঁচজন পক্ষভুক্ত হয়ে রিটটি করেন। ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে রায় দেন। রায়ে আদালত ১৯৭৭ সাল থেকে স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত কর্মাচারীদের উচ্চতর বেতন স্কেল ও বকেয়া বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পরিশোধের নির্দেশ দেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে রেলওয়ের মহাপরিচালক ২০১১ সালে আপিল বিভাগে সিভিল আপিল করেন। তবে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। আদেশে ‘আবেদনকারীরা উচ্চতর বেতন স্কেল পাওয়ার অধিকারী’ মর্মে সিদ্ধান্ত দেন। এর বিরুদ্ধেও রেল মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল করে। ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালত সিভিল রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দুই মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেন।
এ মামলায় সুবিধাপ্রাপ্তদের একজন অবসরপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টার কাজী শহিদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মামলায় কারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন, রায়ে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তবু রেলের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রায় নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করেন।’ হীন উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রেলপথ, আইন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক নথিতে দেখা যায়, উচ্চ আদালতের রায়ের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগ এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত অনুবিভাগের মতামত জানতে চেয়ে পৃথক চিঠি দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। রায়ে তারা স্পষ্ট হতে পারেনি, কর্মচারী ইউনিয়নের কারা এ রায়ের সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। যদিও এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ রয়েছে, স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়ন রিটের আবেদনকারী। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, সংগঠনের সব সদস্যের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে এর সভাপতি রিট করেন। সে অনুযায়ী স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নভুক্ত রেলওয়ের সব স্টেশনমাস্টার, সহকারী স্টেশনমাস্টার এবং স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টদের ক্ষেত্রে এ রায় প্রযোজ্য হবে। শেষে সাব্যস্ত হয়, স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত সব সহকারী স্টেশনমাস্টার, স্টেশনমাস্টার গ্রেড-১, ২, ৩, ৪ ও স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টরাও উচ্চতর স্কেলে বেতন-ভাতা পাবেন।
এ বিষয়ে জানতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। আর রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তিনি সর্বশেষ অবস্থা জানেন না। অবশ্য রেলের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো প্রস্তুত, টাকা দিতেই চাচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে মামলার বাদীপক্ষ কর্মচারী ইউনিয়নের কমিটি নিয়ে। ২০০১ সালের পর থেকে তাঁদের কমিটি নেই। দুটি পক্ষ রায়ে সুবিধাপ্রাপ্তদের দুটি তালিকা দিয়েছে। এখন আমরা কোনটাকে সঠিক ধরে টাকা দেব।’
যদিও মহাব্যবস্থাপকের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন সাবেক স্টেশনমাস্টার মো. শাহজাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের আদেশের সঙ্গে কমিটি বা তালিকার কোনো সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া সব গ্রেডের স্টেশনমাস্টারদের তালিকা রেল প্রশাসনের হাতেই আছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে রেলওয়ের মহাপরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। এর সঙ্গে কর্মচারী ইউনিয়নে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
এ মামলার রায়ে সুবিধাভোগী হবেন, এমন একাধিক স্টেশনমাস্টারসহ রেল কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে অন্তত ২০০ জন মারা গেছেন। অনেকেই জীবনের শেষ বেলায়। সাবেক স্টেশনমাস্টার সৈয়দ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পাওনা না দিলে রেল বলুক যে তোমরা টাকা পাবা না। কিন্তু পাওনা টাকার জন্য জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এভাবে হয়রানি এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে এ রকম তামাশার কোনো অর্থ হয় না।’