তিন জেলায় মন্দির-মণ্ডপে হামলা
৯ মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি
গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলায় দুর্গামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে।
কুমিল্লায় দুর্গামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে তিন জেলায় মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার ৯ মাসেও বেশির ভাগ মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। গত বছরের অক্টোবরে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। তিন জেলায় সব মিলিয়ে মোট ৫১টি মামলায় ৪৩৯ জনকে জ্ঞাত এবং ৫ হাজার ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এর মধ্যে নোয়াখালীতে মাত্র তিনটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘটনার ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বাকি ৪৮টি অর্থাৎ ৯৪ শতাংশ মামলার তদন্ত এখনো শেষই হয়নি।
এসব মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বেশির ভাগ আসামি এখন জামিনে আছেন। এ নিয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার আগেই মামলাগুলোর বিচারকাজ শুরু দেখতে চান।
এ ছাড়া এসব হামলার ঘটনায় তিন জেলায় জেলা ও পুলিশ প্রশাসন পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এসব কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কমিটির কর্মকর্তারা প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলো হচ্ছে দায়সারাভাবে। মামলা করে ভুক্তভোগীদের সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে। আবার অপরাধীদের নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে, এসব মামলায় তাদের কিছুই হবে না। আর তাই মামলা থেকে প্রকৃত অপরাধীরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক উদ্যোগের অভাব আছে। তাদের উদ্যোগ লোকদেখানো। সরকারি প্রশাসন ও পুলিশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িক শক্তির দৃঢ় অবস্থান আছে। তাদের কারণেই কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যখনই যেখানে ঘটেছে, তখনই আমরা অ্যাকশন নিয়েছি। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছি। মামলা হয়েছে, কোনোটার ক্ষেত্রে চার্জশিট দিয়েছি, কোনোটা বিচার পর্যায়ে রয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ লোকদেখানো। সরকারি প্রশাসন ও পুলিশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িক শক্তির দৃঢ় অবস্থান আছে। তাদের কারণেই কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।রানা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
গত বছরের ১৩ অক্টোবর সকালে কুমিল্লা নগরের নানুয়া দিঘিরপাড়ের একটি পূজামণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিনই কুমিল্লা নগরের চারটি মন্দির, সাতটি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। আহত হন অন্তত ৩০ জন। আহতদের মধ্যে একজন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া জেলার সদর দক্ষিণ, দেবীদ্বার ও দাউদকান্দিতে প্রতিমা ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এসব ঘটনায় নয়টি মামলা হয়।
থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, ওই সব হামলার ঘটনায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের জামায়াতদলীয় বর্তমান ও সাবেক তিন কাউন্সিলর ও বিএনপির কয়েকজন কর্মীসহ ৯২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০০ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ পবিত্র কোরআন অবমাননা মামলার প্রধান আসামি ইকবাল হোসেনসহ শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া ওই ঘটনায় কারাগারে আছেন জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান তিনজন কাউন্সিলর।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি চন্দন রায় বলেন, ‘নয় মাসেও কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কোনো বিচার হয়নি। সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হয়নি। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করলে সংখ্যালঘু নির্যাতন কমে আসবে। অবিলম্বে এ ঘটনার বিচার করতে হবে।’
জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, পূজামণ্ডপে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর প্রশাসনকে নিয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা মামলাগুলোর তদন্ত করছে।
নোয়াখালীতে ৩ মামলার অভিযোগপত্র
নোয়াখালীতে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় ৩২টি মামলার মধ্যে তিনটির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে তদন্তকারী সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তিনটি মামলার অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত আসামি মাত্র তিনজন। বাকি ২৯টি মামলাই এখনো তদন্তাধীন। এর মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তিনটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই আদালতে জমা দেবে বলে জানিয়েছে।
হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের হওয়া ৩২টি মামলার মধ্যে সিআইডি তদন্ত করছে ১১টি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে ১১টি, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ পাঁচটি, হাতিয়া থানা-পুলিশ তিনটি, বেগমগঞ্জ থানা একটি ও কোম্পানীগঞ্জ থানা-পুলিশ একটি মামলা তদন্ত করছে। এসব মামলায় ইতিমধ্যে পুলিশ ও তদন্তকারী অন্যান্য সংস্থা প্রায় ২৩০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার আসামিদের প্রায় সবাই উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন বলে জেলা কারাগার সূত্রে জানা গেছে।
গত বছরের ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে কয়েক হাজার মুসল্লি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। একপর্যায়ে মিছিলকারীরা চৌমুহনী ডিবি রোডে (ফেনী-নোয়াখালী সড়ক) এসে একত্র হয়ে হিন্দুদের দোকানপাটে ও মন্দির এবং বাসা-বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর চালান। এ সময় বিজয়া পূজামণ্ডপ এলাকায় হামলায় যতন সাহা (৪২) এবং ইসকন মন্দিরে প্রান্ত চন্দ্র দাস (২৬) নামে দুজন নিহত হন।
মামলার তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডি, নোয়াখালীর বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া ১১টি মামলা তাঁরা তদন্ত করছেন। এর মধ্যে তিনটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া গেছে। শিগগিরই মামলা তিনটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে। এ ছাড়া অন্য আটটি মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।
এদিকে হামলা-ভাঙচুরের ৯ মাস পরও ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও পূজামণ্ডপগুলো পুরোপুরি পুনর্গঠন সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন নোয়াখালী জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী পাপ্পু সাহা। গত শনিবার সকালে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, পূজামণ্ডপ পুনর্গঠনে ঘটনার পর জেলা প্রশাসন থেকে শুধু স্থায়ী মন্দিরগুলোকে ৫০ হাজার টাকা এবং পাঁচ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, পূজামণ্ডপ ও ব্যক্তির নামে কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বরাদ্দ পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই বরাদ্দের চেক সংশ্লিষ্টদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
চাঁদপুরে ৭৯ জন কারাগারে
এদিকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ১০টি মামলার একটিরও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। এসব মামলার মধ্যে পুলিশের কাছে দুটি, ডিবি পুলিশের কাছে দুটি, সিআইডি পুলিশের কাছে তিনটি ও পিবিআইয়ের কাছে তিনটি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাজীগঞ্জ সার্কেল সোহেল মাহমুদ ও সরকারি কৌঁসুলি রনজিত রায় চৌধুরী।
থানা-পুলিশ জানায়, এসব মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ১১৭ আসামির মধ্যে ৩৮ জন জামিনে আছেন। বাকি ৭৯ জন আসামি কারাগারে রয়েছেন।
এসব ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন সম্পর্কে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গত বছরের ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় হাজীগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের হয় এবং পৌর এলাকার কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ গুলি চালায়। এ সময় ঘটনাস্থলে তিনজন, পরে হাসপাতালে দুজনের মৃত্যু হয়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন গাজীউল হক, কুমিল্লা; মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী ও আলম পলাশ, চাঁদপুর]