১৬০ বছরে চট্টগ্রাম সিটি
বৃষ্টি হলেই ডোবে শহর, সেবায়ও পিছিয়ে
১৮৬৩ সালের ২২ জুন চট্টগ্রাম পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু। ওই সময়েও জলাবদ্ধতা সমস্যা ছিল। তা এখনো রয়ে গেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের সুনাম ম্লান। কাঁধে দেনার বড় বোঝা। ১৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রাম শহরের এখন জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ।
একসময় চট্টগ্রাম ছিল প্রাকৃতিক শহর। শহরের ভেতরে ছোট ছোট পাহাড়, পাশে নদী, গাছপালাঘেরা বন। সুন্দর ও শান্ত। শহরের আগের সে সৌন্দর্য ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে। এখন অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় শহর। এই বর্ষাতেও ইতিমধ্যে তিনবার ডুবছে শহর। অথচ জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের প্রেক্ষাপটকে ঘিরে গঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম পৌরসভা। এরপর হয় সিটি করপোরেশন। এর মাঝে কেটে গেছে ১৬০ বছর। তবু জলাবদ্ধতার দুঃখ দূর হয়নি চট্টগ্রামবাসীর; বরং গত ২০ বছরে তা আরও প্রকট হয়েছে।
শুধু জলাবদ্ধতা নয়, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক বাতিসহ নাগরিক সেবায় পিছিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ম্লান হয়েছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের সুনামও। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে করপোরেশনের ভূমিকা উল্টো। এক সময়ের প্রায় স্বনির্ভর সংস্থাটি এখন ডুবছে দেনার ভারে। নগরবাসীর ওপর চাপিয়েছে বাড়তি গৃহকরের বোঝা।
এই পরিস্থিতিতে আজ ২২ জুন যাত্রা শুরুর ১৬০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম পৌরসভা তথা সিটি করপোরেশনের। যদিও পৌরসভা প্রতিষ্ঠার দিন-বছর নিয়ে লেখক-গবেষকদের মতভেদ রয়েছে। তবে সিটি করপোরেশন ১৮৬৩ সালের ২২ জুনকে প্রতিষ্ঠা দিবসকে হিসেবে গ্রহণ করেছে।
চট্টগ্রামকে বলা হয় বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের মহানগরের মধ্যে আকারের দিক দিয়ে ঢাকার পরই চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাশে গড়ে ওঠা শহরের একদিকে পাহাড় ও অন্যদিকে সমুদ্র। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরটি চট্টগ্রাম শহরেই।
সিটি করপোরেশনের নথির তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ৬৪৯ বর্গমাইল আয়তন ও ৪টি ওয়ার্ড নিয়ে ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম পৌরসভা। এর ছয় বছর পর করা পরীক্ষামূলক আদমশুমারি অনুযায়ী শহরে তখন জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৪৭৮। ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। তখন জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। ১৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রাম শহরের এখন জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। ৪১টি ওয়ার্ডে ঘরবাড়ির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ।
চট্টগ্রামে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এগুলোর কারণে সাময়িক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ জন্য মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ছে। তবে কাজগুলো শেষ হলে মানুষ সুফল পাবেগিয়াস উদ্দিন, প্যানেল মেয়র, চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
১৬০ বছরে নগর উন্নয়নে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা ও অর্জন নিয়ে ১২ জুন মন্তব্য জানতে চাইলে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী কথা বলতে রাজি হননি। প্যানেল মেয়র মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, নগরবাসীকে সেবা দেওয়ার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হতে পারে। তবে জলাবদ্ধতা নিরসনে সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে সিটি করপোরেশন।
১৬০ বছরের ‘দুঃখ’
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা ব্রিটিশ আমলের। এ সমস্যা নিরসনে ‘কমিটি ফর দ্য স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য টাউন অব চিটাগাং’ ১৮৫৬ সালের ১৪ মে সভায় বসেছিল। ওই সভার একপর্যায়ে আলোচনা হয়, ‘শহরের যে অংশে দেশীয় লোকজন বসবাস করতেন, জলনিষ্কাশন সেখানে গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছিল। সে জন্য প্রাকৃতিক খাল নালাগুলোর উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।’
ব্রিটিশ আমলে গঠিত ওই কমিটি জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেই থেমে থাকেনি। শহরের জঙ্গল পরিষ্কার এবং জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে উপকমিটিও গঠন করা হয়েছিল সে সময়। জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের ব্যাপারে গঠিত এই কমিটি পরে রূপ নেয় ‘চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি’ বা পৌরসভায়। এরপর সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ দূর করতে ১৯৯৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল ‘চিটাগাং স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টারপ্ল্যান’। ২০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের।
মহাপরিকল্পনায় তিনটি প্রাইমারি (মূল) এবং ১৫টি সেকেন্ডারি (শাখা) খাল খনন, বিদ্যমান মূল ও শাখা খালগুলোর সংস্কার এবং দখলমুক্ত করা, কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলোর মুখে ৩৬টি টাইডাল রেগুলেটর (জোয়ার রোধক ফটক) স্থাপন, পাহাড়ি বালু ঠেকাতে বিভিন্ন খালে ১৯টি সিলট্র্যাপ (বালির ফাঁদ) নির্মাণ, বৃষ্টি বা জোয়ারের পানি সংরক্ষণের জন্য আটটি জলাধার সংরক্ষণ করার প্রস্তাব ছিল।
কিন্তু একটি নতুন খাল খননের প্রকল্প ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন। সে খালও ৯ বছরেও খনন করতে পারেনি সংস্থাটি। এর আগে ২০০৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ১৪ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনের রুটিন কাজে ব্যয় করে ৩২৪ কোটি টাকা। যদিও এর সুফল নগরবাসী পাননি।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৭ সাল থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে জলাবদ্ধতা নিরসনে মোট ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ দুটি, সিটি করপোরেশন একটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ৫ বছরে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও দুর্ভোগ দূর হয়নি। গত বছর অন্তত ১০ বার ডুবেছিল নগর।
ডিজিটালে উল্টো যাত্রা
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নগরবাসীকে দ্রুত ও সহজে সেবা দিতে ডিজিটালের ওপর জোর দিলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যাত্রা উল্টো। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এবং সেবা সহজলভ্য করতে করপোরেশনের উদ্যোগগুলোও নামকাওয়াস্তে।
নগরবাসীকে ডিজিটাল বা অনলাইনে সেবা দেওয়ার জন্য বছর পাঁচেক আগে নানা উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ওই সময় চালু করা হয়েছিল নিজস্ব অ্যাপ ও কল সেন্টার। পরে তা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে যানবাহনের চলাচল বা গতিবিধি নজরদারির ভিটিএস (ভেহিকেল ট্রেকিং সিস্টেম) এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অবস্থান শনাক্তের প্রক্রিয়া চালু নেই।
বর্তমানে সিটি করপোরেশনের দেনার পরিমাণ সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুতোষিক পাওনা ৪৬ কোটি টাকা। ঠিকাদাররা পাবেন ৫৭৯ কোটি টাকা।
ভবনের গৃহকর কিংবা ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্সের ফি পরিশোধে চালু করা হয়েছে অনলাইন সেবা। তাও যতটা না নগরবাসীকে সেবা দেওয়ার জন্য, তার চেয়ে করপোরেশনের নিজস্ব স্বার্থে। অটোমেশন প্রক্রিয়া চালু না করলে পঞ্চবার্ষিক মূল্যায়ন (বর্ধিত গৃহকর) অনুযায়ী গৃহকর আদায় করতে পারবে না, মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনায় তড়িঘড়ি করে গত বছর অটোমেশন পদ্ধতি চালু করা হয়। কিন্তু এর প্রচার নেই।
আবার নগরবাসীর জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে হয় সিটি করপোরেশন থেকে। কাগজে-কলমে এই সেবা অনলাইনেই দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষকে ঠিকই ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ধরনা দিতে হচ্ছে।
অনলাইন সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরোনো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যেখানে পিছিয়ে আছে সেখানে তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সিলেট ও রাজশাহীর মতন সিটি করপোরেশনগুলো। ইতিমধ্যে নিজস্ব অ্যাপ চালু করেছে। অনলাইনের পাশাপাশি বিকাশ বা রকেটেও বিভিন্ন কর পরিশোধ করা যায়। নগরবাসীর অভিযোগ জানতে অ্যাপ চালু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এটি ব্যবহার করে খুব সহজেই সমস্যার কথা জানাতে পারছেন ঢাকার বাসিন্দারা। শুধু দেশেই নয়, প্রতিবেশী কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনেরও নিজস্ব অ্যাপ রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ডিজিটাল সেবা দিতে যে উদ্যোগ বা অর্থের প্রয়োজন তা দিতে রাজি নন তাঁরা। ওই কর্মকর্তার দাবি, সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের ৮০ ভাগই চলছে ম্যানুয়াল বা সনাতন পদ্ধতিতে।
রাজস্বসহ সব সেবা খাতের নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরি করে সব সেবাকে ওয়ানস্টপ ডিজিটাল সার্ভারের আওতায় আনাসহ ডিজিটাল সেবার বিষয়ে তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর পরেও এগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।
দেনায় ডুবছে
বর্তমানে সিটি করপোরেশনের দেনার পরিমাণ সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুতোষিক পাওনা ৪৬ কোটি টাকা। ঠিকাদাররা পাবেন ৫৭৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া ২৫ কোটি টাকা।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী দায়িত্ব ছাড়ার সময় বকেয়া ছিল ২০ কোটি টাকা। মোহাম্মদ মনজুর আলম যখন দায়িত্ব ছাড়েন তখন দেনা ছিল ১১৭ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি টাকায়।
কেউ যদি একবার ঘুরে আসেন, তাহলে দেখবেন চট্টগ্রাম একটি অগোছালো ও অপরিচ্ছন্ন নগর। মোড়ে মোড়ে ময়লার স্তূপ। ফুটপাত দখল হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট ভাঙা। রাতে সড়কবাতি জ্বলে না। অথচ একসময় নগরের এই অবস্থা কল্পনা করা যেত না।
সিটি করপোরেশন বছরে গড়ে চার শ থেকে সাড়ে চার শ কোটি টাকা আয় করে। এর মধ্যে বেতন-ভাতা ও পারিশ্রমিক খাতে ব্যয় হয় ২৭৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা ব্যয় হয় মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানি, রাস্তা সংস্কারসহ বিভিন্ন খাতে। শেষ পর্যন্ত উদ্বৃত্ত থাকে খুব কম।
সিটি করপোরেশনের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের আয়-ব্যয়ের বর্তমান যে অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে দেনামুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁরা প্রায় ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে।’
নাগরিক সেবায় পিছিয়ে
স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ আইন অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও মাতৃসদন পরিচালনা, পানিনিষ্কাশন, জলাধার রক্ষা, রাস্তার উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ, সড়কবাতির ব্যবস্থা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণসহ ২৮ ধরনের কাজের দায়িত্ব রয়েছে সিটি করপোরেশনের কাঁধে। যদিও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সড়কবাতি স্থাপনকে মূল দায়িত্ব হিসেবে পালন করে।
এসব সেবায়ও পিছিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম। নগর অবকাঠামো উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক বাতি উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগর উন্নয়ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই সিটি করপোরেশনের অবস্থান এখন ১৮–তে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল নবম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ১৪তম।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের মূল সড়কগুলো এখন কিছুটা ঠিক থাকলেও বর্ষার পরপরই খানাখন্দ সৃষ্টি হয়। অলিগলি ও শাখা সড়কগুলো বছরের বেশির ভাগ সময় বেহাল থাকে। নিম্নমানের কাজ ও উন্নয়নকাজ ভাগাভাগির কারণে অল্প সময়ে নগরের রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার ৩৩ বছরেও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারেনি সংস্থাটি। জাইকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নগরে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হলেও সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে দুই হাজার টন। বাকি এক হাজার টনের অধিকাংশ নালা-নর্দমা ও খালে চলে যায়। যা জলাবদ্ধতার অন্যতম বড় কারণ বলে জানিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রকৌশলীরা। এ ছাড়া মশকনিধনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে ২৫ শতাংশ এলাকা।
এ প্রসঙ্গে প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এগুলোর কারণে সাময়িক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ জন্য মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ছে। তবে কাজগুলো শেষ হলে মানুষ সুফল পাবে।’
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি ও নগরের প্রবীণ বাসিন্দা অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, নগরকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন এবং নগরবাসীকে সুস্থ রাখা সিটি করপোরেশনের কাজ। কিন্তু কেউ যদি একবার ঘুরে আসেন, তাহলে দেখবেন চট্টগ্রাম একটি অগোছালো ও অপরিচ্ছন্ন নগর। মোড়ে মোড়ে ময়লার স্তূপ। ফুটপাত দখল হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট ভাঙা। রাতে সড়কবাতি জ্বলে না। অথচ একসময় নগরের এই অবস্থা কল্পনা করা যেত না। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ফিকে হয়েছে সুনাম
এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সুনাম অর্জন করেছিল সিটি করপোরেশন। তবে সে সুনাম আর নেই। পরিসংখ্যানেই এই অবনতির চিত্র উঠে এসেছে।
২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের তুলনায় এগিয়ে ছিল সিটি করপোরেশনের কলেজগুলো। বোর্ডের যেখানে পাসের হার ৭০ শতাংশ, সিটি করপোরেশনের এ হার ছিল ৭৮ শতাংশ। সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষায় সিটি করপোরেশনের কলেজগুলোর গড় পাসের হার (৭৮ শতাংশ) বোর্ডের তুলনায় কম (৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ)।
সিটি করপোরেশনের আয়-ব্যয়ের বর্তমান যে অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে দেনামুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁরা প্রায় ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে।হুমায়ূন কবির, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিদায় নেওয়ার বছরে (২০১০-১১ অর্থবছর) সিটি করপোরেশনের মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছিলেন ৭ লাখ ৬ হাজার ১৭১ জন। ২০২১-২২ অর্থবছরে একই ধরনের সেবা নিয়েছেন অর্ধেকেরও কম, ৩ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ জন।
নগরের বিশিষ্টজনদের মত, নূর আহমদ চেয়ারম্যানের সময় শিক্ষা খাতে তখনকার পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরীও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনেক বিনিয়োগ করেছিলেন। সে ধারা ধরে রাখতে পারেননি উত্তরসূরিরা।
দায়িত্বে ছিলেন যাঁরা
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন জে ডি ওয়ার্ড। ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পৌরসভা থেকে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে উন্নীত করা হলে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার মফিজুর রহমান চৌধুরীকে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন করা হয় ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাইয়ে। প্রথম মেয়র ছিলেন জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর মেয়র ছিলেন বিএনপির মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। সিটি করপোরেশন প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন বিএনপির মোহাম্মদ মনজুর আলম ও আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীন। করোনার কারণে ২০২০ সালে নির্বাচন না হলে প্রশাসকের দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগের মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
সমন্বয়ে ঘাটতি
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামে গত এক-দুই দশক ধরে প্রকট হয়েছে জলাবদ্ধতার সমস্যা। জলাবদ্ধতা নগরকে পঙ্গু করে ফেলে। অন্তত ছয় মাস নগরের সব কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। বর্ষা ভারী হলে এ সমস্যা আরও ভয়াবহ হয়৷ জলাবদ্ধতার পেছনে পাহাড় কাটা, কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, খাল নালা দখল হওয়াসহ নানা কারণ আছে। এ ক্ষেত্রে এই সমস্যা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব না। কিন্তু সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সিটি করপোরেশন সিডিএ, ওয়াসাকে সঙ্গে নিয়ে এই সমস্যা নিরসনে কাজ করতে পারেনি।
দেনা প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আর দুর্নীতির কারণে সিটি করপোরেশন আর্থিকভাবে দায়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের বড় বড় পদে থাকা ব্যক্তিদের সেবা দেওয়ার চেয়ে ঠিকাদারিতে মনোযোগ বেশি। কাউন্সিলররা পুরো নগর নিয়ে ভাবেন না। আবার সিটি করপোরেশনও বিশেষায়িত জ্ঞান সম্পন্ন পেশাজীবীদের মতামত নেন না এবং তাঁদের কথাকে গুরুত্ব দেন না।