৯ মাসে ১৪ হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মা-বাবার জন্মভূমিতে
এদেশে তিনি বসবাস করেননি। এদেশের সঙ্গে সে অর্থে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ নেই। এরপরও সীমান্তে প্রবেশের আগের কয়েক ঘণ্টা তাঁর মধ্যে উত্তেজনা কাজ করেছে। বাংলাদেশের প্রবেশদ্বারে স্বাগত জানিয়ে লেখা সাইনবোর্ডের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হেলমেট খুলে সাইকেলে পা রেখে ছবি তুললেন। বহু পথ সাইকেল চালানোর ক্লান্তির মধ্যেও ছবিতে ধরা পড়েছে মুখের উজ্জ্বল হাসি।
সামনাসামনি আলাপেও সেই হাসি ছিল তরুণের মুখে। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে এসে অনুভব করি, এই দেশ আমার জন্য বিশেষ কিছু। এখানে আমার পরিবার রয়েছে।’
তরুণের নাম নাবিল ইসলাম (৩০)। জন্ম থেকেই ফ্রান্সে। অনেকের মতো স্বপ্ন ও সিদ্ধান্তের মধ্যে দূরত্ব রাখেননি। সাইকেলে চেপে বিদেশে ঘুরবেন স্বপ্ন থেকে পাঁচ বছর ধরে অর্থ জমিয়েছেন। এরপর প্রকৌশলীর চাকরি ছেড়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এরই মধ্যে ইউরোপ ও এশিয়ার এক ডজনের বেশি দেশ ঘুরেছেন। যাত্রার সাড়ে ৯ মাস পর এখন তিনি মা-বাবার জন্মভূমি বাংলাদেশে। এতগুলো দেশ ঘুরতে গিয়ে দুবার উড়োজাহাজে চড়তে হয়েছে তাঁকে। কয়েকবার নৌপথেও চলতে হয়েছে। তবে এরই মধ্যে তিনি ১৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন সাইকেলে। গত ২৯ নভেম্বর তিনি ভারতের ডাউকি সীমান্ত থেকে সিলেট হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ২ ডিসেম্বর আসেন ঢাকার বাসাবোয় ফুপুর বাসায়। পরদিন রোববার সেই বাড়িতে বসে কথা হয় নাবিল ইসলামের সঙ্গে। তাঁকে ঘিরে ছিলেন স্বজনেরা।
নাবিলের মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছে। কারণটা জানতেই বললেন, এটা ডিসেম্বর মাস। মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে কীভাবে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই গল্প শুনেছেন অনেকবার।
বাংলাদেশে এসে সিলেটের একটি হোটেলে উঠে নিরামিষভোজী নাবিল খেয়েছেন ভাত, সবজি আর ডাল। দুই দিন সিলেটে থাকার সময় খাবার কিনতে গিয়ে ভাঙা বাংলায় বলেছেন, ‘মাছ ছাড়া, মাংস ছাড়া’ খাবার চান। পছন্দের খাবারের তালিকায় আছে ডালপুরি, আলুপুরি, শীতের পিঠা, পরোটা, ডিমভাজি ও ঢ্যাঁড়সভাজি।
মা-বাবার সূত্রেই ভাঙা বাংলা বলতে পারেন তিনি। তাঁর বাবা শরিফুল ইসলাম একজন চিকিৎসক (কিডনিরোগবিশেষজ্ঞ)। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তখন তিনি নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বাধীন দেশে পড়াশোনা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৯৮০ সালে তিনি ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে চলে যান। পরে সেখানেই স্থায়ী হন।
শরিফুল ইসলাম ও ফওজিয়া ইসলাম দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট নাবিল। ইলেকট্রনিক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হিসেবে ফ্রান্সের রেলওয়েতে পাঁচ বছর কাজ করেছেন। এটা তাঁর তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে আসা। তবে এই প্রথম তিনি এলেন সাইকেল চালিয়ে। কাকতলীয়ভাবে ডিসেম্বরে তাঁর বাংলাদেশে আসা। মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে কীভাবে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই গল্প শুনেছেন অনেকবার।
পরিবেশদূষণ রোধে সামান্য অবদান
নাবিল ইসলাম থাকেন ফ্রান্সের ঘোনাব্লা শহরে। নিজ শহরেও তিনি সাইকেল চালিয়ে ঘোরেন। তাঁর ভাষায়, পরিবেশদূষণ রোধে এটা তাঁর সামান্য অবদান। ছবিতে দেখা গেছে, এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিজের বাসার সামনে থেকে হলুদ জ্যাকেট আর হলুদ টুপি পরে যখন বেরিয়েছিলেন, তখন সাইকেল ও সাইকেলে রাখা বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগের রং ছিল চকচকে। গত সাড়ে ৯ মাসের দীর্ঘ ভ্রমণে সাইকেল ও ব্যাগগুলোর এখন দৈন্যদশা। কখনো সমতল থেকে হাজার হাজার ফুট ওপরে উঠেছেন, কখনো ঝম ঝম বৃষ্টিতে ভিজে, কখনো কড়া রোদে, কখনো তীব্র ঠান্ডায় দিন–রাত কেটেছে। বেশির ভাগ সময়ে তাঁবু খাটিয়ে বা স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছেন। এই কয়েক মাসে একাধিকবার অসুস্থ হয়েছেন। বেশি ভুগেছেন পেটের পীড়ায়।
দুর্ভোগ যেমন ছিল, তেমনি মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছে। নাবিল বলেন, সাইকেল চালাতে চালাতে অনেক সময় সাইক্লিং গ্রুপ পেফে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে মিশে গেছেন। কয়েকজন তাঁর বাড়িতেই নিয়ে গিয়ে খাইয়েদাইয়ে দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো জায়গায় তাঁরা সবাই মিলে ক্যাম্প করে থেকেছেন। রান্না করে খেয়েছেন। নেপালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এক জার্মান সাইক্লিস্টের সঙ্গে। তিনিও এখন নাবিলের সঙ্গে বাংলাদেশে।
তিন মাস আগে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত
শুরুতেই বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা ছিল কি না, জানতে চাইলে নাবিল বলেন, আগস্ট মাসে কাজাখস্তানে বসে মানচিত্র দেখে ঠিক করছিলেন পরবর্তী গন্তব্য। সেই সময় হুট করে বাংলাদেশে আসার আগ্রহ হয়। এখানে এসে তাঁর মনে হয়েছে, এদেশ সাইকেল চালানোর জন্য নিরাপদ।
অনেকের মতো স্বপ্ন ও সিদ্ধান্তের মধ্যে দূরত্ব রাখেননি। সাইকেলে চেপে বিদেশ ঘুরবেন স্বপ্ন থেকে পাঁচ বছর ধরে অর্থ জমিয়েছেন। এরপর প্রকৌশলীর চাকরি ছেড়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
নাবিল জানান, সাইকেলে তিনি আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। তবে এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ যাত্রা। প্রথমে ইতালি, সেখানের আনকোনা শহর থেকে ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট শহরে গেছেন নৌকায়, এরপর মন্টেনেগ্রো, আলবেনিয়া, কসোভো, মেসিডোনিয়া, গ্রিস, তুরস্ক, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া পর্যন্ত সাইকেলেই ঘুরেছেন। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার স্থলসীমান্ত বন্ধ থাকায় পরবর্তী গন্তব্যে যেতে আর্মেনিয়া থেকে উড়োজাহাজে চড়েন। সাইকেলটি চলে যায় মালামালের সঙ্গে। তখন জুন মাস। উড়োজাহাজ থেকে কাজাখস্তান নেমে সাইকেল নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন তিনি। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান হয়ে কিরগিজস্তান সীমান্ত পৌঁছেছিলেন; কিন্তু সংঘাতের কারণে ওই সময় তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তান সীমান্ত বন্ধ ছিল।
নাবিল তাজিকিস্তান থেকে কাজাখস্তান ফিরে আসেন আগস্ট মাসে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন তিনি বাংলাদেশে আসবেন। মা–বাবাকে জানানোর পর তাঁরা আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁরাই বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনকে জানান, ঘুরতে ঘুরতে যেকোনো সময় বাংলাদেশে আসবেন নাবিল। এরপর দেশে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে সময়ে সময়ে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ শুরু হয় নাবিলের।
নাবিল জানান, কাজাখস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে ভারতের দিল্লিতে পৌঁছান। সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে বাসে পৌঁছান জম্মু ও কাশ্মীর। সেখান থেকে সাইকেলে লাদাখ, এরপর উত্তরাখন্ডে এবং উত্তরাখন্ড থেকে হিমালয়ের পাদদেশ নেপালে। সেখানে গিয়ে তিনি পর্বতারোহনের স্বাদ নেন। ট্রেকিং করেন অন্নপূর্ণা পর্বতে। এরপর আবার সাইকেল নিয়ে ছুটে চলা। নেপালের কাঠমান্ডু ও বীরগঞ্জ হয়ে ভারতের বিহারে পৌঁছান। বিহার থেকে বাসে যান শিলিগুড়িতে। সেখান থেকে সাইকেলে দার্জিলিং ঘুরে আসাম রাজ্যের ধুবড়ী এসে নৌকায় পার হন ব্রহ্মপুত্র নদ। এরপর মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং ঘুরে ছুটতে থাকেন বাংলাদেশের দিকে।
ঝোলায় জমেছে অনেক স্মৃতি
২০০৬ সালে শেষবার কিশোর বয়সে বাংলাদেশে এসেছিলেন নাবিল। ১৭ বছরে অনেক পরিবর্তন তাঁর চোখে ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ রাস্তাই চওড়া ও মসৃণ। উঁচু ভবনের সংখ্যা বেড়েছে। হাতে হাতে স্মার্টফোন। নেটওয়ার্কও ভালো। রিকশাগুলোতেও এখন ইঞ্জিন (ইজিবাইক)। আর অনেক ভাইবোনের বিয়ে হয়ে সন্তান হয়ে গেছে, যাদের শিশু দেখে গিয়েছিলেন, তাঁরা বড় হয়ে গেছে।’
নাবিলের ফুপাতো ভাই দীপু মাহমুদ জানান, তাঁর মামাও (নাবিলের বাবা) দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন। এবার দেশে আসার পর থেকে নাবিল পরিবারের সঙ্গ, খাবার, চারপাশ সবকিছুই পছন্দ করছেন। ঢাকার বিভিন্ন ছবি দেখে নাবিল আহসান মঞ্জিলে যেতে চেয়েছেন।
নাবিল জানান, তাঁর ভ্রমণ এখনো শেষ হয়নি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গ এত বেশি ভালো লাগছে যে ঢাকার বাইরে যেতে চান না। এর–ওর বাসায় ঘুরতে চান। ১২ ডিসেম্বর তিনি উড়োজাহাজে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে যাবেন। এরপর সাইকেলে তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশ ঘুরবেন। মা–বাবার সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে কী কী গল্প করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কবে ফ্রান্সে ফিরবেন জানেন না। তাঁদের সঙ্গে সামনাসামনি কবে দেখা হবে জানেন না। তবে এ দেশ থেকে অনেক মধুর স্মৃতি সংগৃহীত হয়েছে। এটা তাঁর মধ্যে আবারো এখানে আসার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে।