ন্যূনতম সংস্কার করে এবং আরও সংস্কারের শর্ত দিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত

গত ২৬ ডিসেম্বর চব্বিশের ছাত্র–জনতার আন্দোলন এবং আগামী দিনের বাংলাদেশ নিয়ে এক আলোচনায় এসব কথা উঠে এসেছে। আলোচনার আয়োজন করে প্রথম আলো। রাজধানীর কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ওই আলোচনায় অংশ নেন লেখক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এবং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আন্দোলনকর্মী ও তরুণ গবেষক মীর হুযাইফা আল মামদূহ। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ

চব্বিশের আন্দোলন ও আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে প্রথম আলোর আলোচনায় (বাঁ দিক থেকে) উমামা ফাতেমা, জাহেদ উর রহমান, সলিমুল্লাহ খান ও মীর হুযাইফা আল মামদূহছবি: প্রথম আলো

সাজ্জাদ শরিফ

নানা ঘটনায় ভরা পুরোনো বছর বিদায় নিচ্ছে। আসছে সম্ভাব্য ঘটনাবহুল নতুন আরেকটি বছর। যে পাতানো নির্বাচনী ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল সে রকম একটি নির্বাচন দিয়ে। কিন্তু সেই একতরফা নির্বাচনের পর সরকার একটি বছরও শেষ করতে পারল না। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান হলো। শেখ হাসিনা পালালেন। তাঁর সরকার শিঁকড়সুদ্ধ পড়ে গেল। রাষ্ট্রের প্রবীণ নাগরিকেরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া এত বড় ঘটনা বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। নানা স্তরের এত বিপুল লোকও কোনো আন্দোলনে অংশ নেয়নি। এই গণ–অভ্যুত্থান রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে অনেক নতুন প্রশ্ন হাজির করেছে। দেখার মতো বহু দরজা খুলে গেছে আমাদের সামনে। নাগরিকেরা এসব নিয়ে তুমুল আলোচনা ও বিতর্ক করছেন। আমরাও নতুন বছরের সন্ধিক্ষণে আলোচনায় বসেছি।

উমামা ফাতেমাকে দিয়েই শুরু করি। আপনি তরুণ প্রজন্মের সদস্য। গণ–অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন। আপনাদের আন্দোলনে বহু মানুষ যুক্ত হলো। অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতি তৈরি হলো। রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ নিয়ে আপনাদের স্বপ্নটা কী?

উমামা ফাতেমা

অভ্যুত্থানের সময় আমরা অনেক আশাবাদী ছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। অভ্যুত্থানের পর মনে হচ্ছে, সব মানুষ আসলে একই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসেননি। প্রত্যেকে আস্তে আস্তে তার এজেন্ডা অনুযায়ী সরে যাচ্ছে। চিন্তার এই বৈচিত্র্য অভ্যুত্থানের সময় এতটা চোখে পড়েনি।

জুলাইয়ে যা ঘটেছে, তা হলো মানুষের চূড়ান্ত হতাশা ও বিষণ্নতার বিস্ফোরণ। ১৫ বছর ধরে এখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা একদমই রুদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন আমার মনে হয়, আমাদের শান্ত, স্থির এবং অনেক বেশি সুসংহত হওয়া উচিত। অভ্যুত্থানের সময় দেশটাকে টিকিয়ে রাখতে চাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে ছিল, তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকে আমি তখনই সফল মনে করব, যখন দেশের কৃষক থেকে ধনী পর্যন্ত সবার মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আসবে, সবার সমান সামাজিক নিরাপত্তা থাকবে।

সাজ্জাদ শরিফ

নানা গোষ্ঠী ও মানুষের নানা বাসনা আন্দোলনের সময় হাসিনার সরকারের পতনের দাবিতে এসে মিলে গিয়েছিল। কারণ বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠীর বাসনা সরকার আর পূরণ করতে পারছিল না। তরুণেরাও তাদের বাসনা নিয়ে আন্দোলনে এসেছিলেন। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে হুযাইফা কি বলবেন আন্দোলনের পেছনে তরুণদের বাসনা কী ছিল?

মীর হুযাইফা আল মামদূহ

জুলাই আন্দোলনের সময় তরুণেরা বলছিলেন, আমরাই বিকল্প। প্রত্যেকেই নিজের দক্ষতা ও প্রতিভার জায়গা থেকে দেশের জন্য কাজ করার কথা বলছিলেন। আমরা তরুণেরা একটা সুন্দর দেশ চেয়েছি, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ পরিচয় নিয়ে সুন্দরভাবে বসবাস করবে। কেউ বঞ্চনার শিকার হবে না। সর্বত্র ন্যায্যতা থাকবে। কেউ কাউকে দমিয়ে রাখবে না। পরে দেখলাম, যাঁরা আন্দোলনে ছিলেন এবং পরে উপদেষ্টা হলেন, তাঁদের জন্য বড় বড় গাড়ি এল। তাঁরা কেউ সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন না। আমি এতে খুব আহত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, একটা বদল আমাদের দরকার ছিল।

সাজ্জাদ শরিফ

জাহেদ উর রহমানের কাছে আসি। গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রায় চার মাস পার হলো। বিপুল প্রত্যাশার বিপরীতে এই সময়ে আমরা ভাবাদর্শ ও রাজনীতির নানা মেরুকরণ দেখছি। কোনো কোনো পক্ষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতেও দেখছি। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি মীমাংসার অতীত। আপনি এই সময়টাকে কীভাবে দেখছেন?

রাজনৈতিক দল ছাড়া যেহেতু রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলবে না, সে কারণে নির্বাচনের সংস্কার চাইলে রাজনৈতিক দলের ভেতরেও সংস্কারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

জাহেদ উর রহমান

পরিস্থিতি যেখানে এসে পৌঁছেছে, এখানে এসে পৌঁছাবে বলেই আমি ধারণা করেছিলাম। আমি খুব বেশি প্রত্যাশা করিনি। হুযাইফা তরুণদের আকাঙ্ক্ষার কথা বললেন। কোন তরুণ, সেটা সংজ্ঞায়িত করার ব্যাপার আছে। কেউ কেউ বলছেন, জনগণ এটা চাইছে। কোন জনগণের কথা বলা হচ্ছে, সেটাও সংজ্ঞায়িত করতে হবে। আমরা নিজেরা যাঁদের জনগণ বা তরুণ বলে মনে করি, তাঁদের কথাই সামনে আনছি। রাজনৈতিক দলগুলো এটাই দীর্ঘ দিন ধরে করে আসছে।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার পতনের জন্য শুরু হয়নি। আন্দোলন একটা পর্যায়ে এসে এদিকে মোড় নিয়েছে। কীভাবে আমরা দেশটাকে গড়তে চাই, সে ভাবনা নিয়ে কি প্রস্তুত ছিলাম? আমাদের সামনে কি কোনো ইশতেহার ছিল? আমাদের প্রত্যেকের চাওয়ার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিলেন শেখ হাসিনা। তাই আমরা তাঁকে সরাতে চেয়েছি। আমরা কে কী চাই, সে লড়াই এখন চলছে। এতে কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু কী হচ্ছে? ভারতকে নিয়ে একটা উগ্র অবস্থান চাওয়া হচ্ছে। ভারতের সমালোচনা মানে হলো, আপনাকে বলতে হবে যে সেভেন সিস্টার্স ভেঙে দিতে হবে।

প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে আপনার সমালোচনা থাকতে পারে। আপনি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন, বিতর্ক করুন। কিন্তু না, প্রথম আলোর অফিসে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। সবকিছুর একটা র্যাডিক্যালাইজশন দেখতে পাচ্ছি। এটাই সমস্যা। কারণ হচ্ছে আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রত্যেকে এখন নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন।

যাঁরা বলছেন সবকিছু বাতিল করে দিয়ে বিপ্লবী সরকার তৈরি হতে হবে, তাঁরা আদৌ তার আশপাশে যাননি। একটা স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে এ রকম একটা বয়ান তৈরির চেষ্টা করা হলো। এ রকম কিছু একদেশদর্শী চিন্তা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছি।

ভবিষ্যতের জন্য খুব মৌলিক জায়গায় কিছু আশা তৈরি করা এবং সেগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করা দরকার। আমরা যদি গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাই, তাহলে দীর্ঘ যাত্রার জন্য আমাদের তৈরি হতে হবে। তার জন্য সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের একটা বাস্তব চিন্তা মাঠে ছাড়া দরকার। শেখ হাসিনা বিশেষ করে গত ১৩ বছরে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করে গেছেন, সেটা ঠিক করার জন্য আমাদের যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে, সময় লাগবে।

ছাত্র উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ‘শুধু একটা নির্বাচনের জন্য অভ্যুত্থান হয়নি।’ আমি বলব, বড় অংশীজনদের সম্পৃক্ত না করে সংস্কার চাপিয়ে দিলে সেটা টিকবে না। আমরা অনেক বেশি ভাবাদর্শিক বিতর্কে ঢুকে যাচ্ছি। এ বিতর্কে ঢোকার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে জনগণের কল্যাণের আলোচনা কমতে থাকে।

সাজ্জাদ শরিফ

গণ–অভ্যুত্থানের পরে বিপুল জন–আকাঙ্ক্ষার সামনে বিস্তর চ্যালেঞ্জও চলে এসেছে। সলিমুল্লাহ খান কি নতুন বছরে প্রবেশের আগে ইতিবাচক কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছেন?

সলিমুল্লাহ খান

শুধু একটা নির্বাচনের জন্য অভ্যুত্থান হয়নি, এ কথা ঠিক। আবার অভ্যুত্থান নির্বাচনের জন্যও হয়েছে বটে। একে বাদ দেওয়া যাবে না। উদার গণতান্ত্রিক দেশে যে ধরনের নির্বাচন হয়ে থাকে, তা হওয়ার পথে এখানে যে বাধাগুলো আছে, তা দূর করাই প্রথম সংস্কার। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সব মানুষ একত্র হয়েছিলেন, কারণ মানুষকে তিনি ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। আরও কতগুলো বিষয় ছিল। দেশে নানা প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। মানুষ দুর্নীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অত শক্তি ছিল না বলে প্রতিরোধ করেনি। শেখ হাসিনাকে অপসারণের জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি এসে তাদের প্রতীক্ষার মুহূর্ত শেষ হয়।

অনেকে বলেন, আন্দোলনে কোনো ইশতেহার ছিল না, সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি। অথচ শেখ হাসিনাকে অপসারণের আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সব উপাদান ছিল। জুলাইয়ের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো এটা ছাত্র ও জনগণের দিক থেকে মোটামুটি নিরস্ত্র ছিল। এভাবে শেখ হাসিনাকে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে বলেই সম্ভবত ইকোনমিস্ট পত্রিকা এই আন্দোলনের সূত্রে সারা পৃথিবীর সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচন করেছে।

সংস্কার আমাদের দুই জায়গায় করতে হবে—একটা রাষ্ট্রে, আরেকটা সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আমাদের সংস্কারের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। আমি বলছি না যে আগামী বছরই তা করা যাবে বা এটা অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মসূচি।

নাগরিকদের কর্মসূচি জুলাই আন্দোলনের আগে ইশতেহার আকারে হাজির করা সম্ভব ছিল না। তবে শেখ হাসিনার সরকারকে অপসারণের মধ্য দিয়ে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে, তার সারমর্ম এই যে হাসিনা যা যা করেছেন, তার বিপরীত করতে হবে। হাসিনা নির্বাচন দেননি, নির্বাচন দিতে হবে। হাসিনা দুর্নীতি করেছে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। হাসিনা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, সেটা বন্ধ করতে হবে। হাসিনা যে ধরনের লোকদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করেছিলেন, সে ধরনের লোকদের নিয়োগ করা যাবে না। এটাকে বলতে পারি রাষ্ট্র পর্যায়ের সংস্কার। আর নাগরিক সমাজের সংস্কার মানে, আমাদের স্বাচিপ–ড্যাব ভাগাভাগি, সাংবাদিকদের ভাগাভাগি—এগুলো দূর করা জরুরি।

ব্রিটিশ আমলে ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক ছিল, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যে সম্পর্ক ছিল, ভারতের সঙ্গে আমাদের তো সেই সম্পর্কই হয়ে গিয়েছিল। এখানে আমাদের হাত দেওয়া দরকার। শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার করলে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে যেতে পারব।

আমি মনে করি, ন্যূনতম সংস্কার করে এবং আরও সংস্কারের শর্ত দিয়ে আমাদের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল যে সেটা এক ব্যক্তির সার্বভৌমত্বে পরিণত হয়েছিল। যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ করতে না দেওয়াই সংগত। অনেকে বলবেন, তাতে তো নির্বাচন বৈধ হবে না। তাহলে কি তাদের অপরাধ আপনি অস্বীকার করছেন? যাঁরা নির্বাচন কমিশনের সদস্য ছিলেন, তাদের কেন কারারুদ্ধ করা হয়নি? এগুলো না করে কীভাবে সংস্কার হতে পারে!

সাজ্জাদ শরিফ

উমামার কাছে আবার ফিরি। আমাদের প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো মোটের ওপর দ্রুত নির্বাচন চাইছে। ছাত্ররা নির্বাচন চাইছেন উল্লেখযোগ্য সংস্কারের পরে। পুরোনো আর নতুন রাজনীতি প্রায় মুখোমুখি একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর কোনো উপায় আছে?

উমামা ফাতেমা

জটিল প্রশ্ন। আমি এই অভ্যুত্থানকে সংস্কার আর নির্বাচন—এ দুই পরস্পর–বিরোধিতার মধ্যে দেখি না। মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সংস্কার বা নির্বাচনের মধ্যে সীমিত করার একটা প্রবণতা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দেখছি। পুরো বিতর্ক এখন রাজনৈতিক দল বনাম ছাত্র কিংবা নির্বাচন বনাম সংস্কার হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের দরকার মৌলিক পরিবর্তনগুলোর দিকে তাকানো।

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্যের কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। এমনভাবে ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে, যাতে বিভাজনটাই দিন শেষে ফল হয়। 

দেশে যদি কোনো মৌলিক পরিবর্তন করা না যায়, তাহলে যারা মৃত্যুর সামনে রাস্তায় লড়াই করেছেন, সেই বৃহৎ তরুণসমাজের বড় অংশ খুবই হতাশ হবে। সামনের দিনে এর বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ হয়তো আমরা দেখতে পাব।

মীর হুযাইফা

ক্ষমতায় থাকা মানুষের পরিবর্তন হয়েছে, অথচ কথা কিন্তু একই রকম আছে। ছাত্ররা যে নিজেদের ক্ষমতাধর ভাবছে, এটাও একটা সমস্যা।

উমামা ফাতেমা

আন্দোলনে ছাত্রদলও ছিল। ৫ আগস্টের পর মনে হয়েছিল, বিএনপি পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখছি, বিএনপি এখন শুধু নির্বাচনের কথা বলছে। আবার বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখাবে না, ছাত্ররা যেন তেমন একটা অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। এই দুটি শক্তি যে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে পড়ছে, এটা মানুষের জন্য ভালো হচ্ছে না। এ রকম চললে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মর্ম নষ্ট হয়ে যাবে।

সাজ্জাদ শরিফ

ভাবাদর্শগত কোনো ইশতেহার সামনে রেখে আন্দোলন হয়নি, এটা সত্য। আবার আন্দোলনের স্লোগানে বা গ্রাফিতিতে মানুষের মুক্তি, সমতা ও ইনসাফের বাসনার প্রকাশও আমরা দেখেছি। এখন তীব্র ভাবাদর্শগত মেরুকরণ ঘটছে। আন্দোলনে থাকা ডানপন্থীদের কট্টর অংশটি বামপন্থীদের নাকচ করে দিচ্ছে। দরজাগুলো কি বন্ধই হয়ে যাবে? খোলা রাখার কোনো উপায়ই নেই?

মীর হুযাইফা

রাজনীতি মানেই ভাবাদর্শ। ৫ আগস্টের পরে রাজনীতিতে তৈরি হওয়া শূন্যতায় প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাবাদর্শকে ক্ষমতাশালী করতে চাইছে। সব ভাবাদর্শের মানুষকে একসঙ্গে বসিয়ে একটা সংলাপের আয়োজন করা গেলে ভালো হতো। এটাই সবচেয়ে জরুরি।

সাজ্জাদ শরিফ

অনেক নাগরিক চাহিদা থাকবে, কিন্তু সবাই মিলে সামনে বাড়তে গেলে ন্যূনতম সমঝোতা তো লাগবে। নইলে সংঘাতের বীজ পুষে রেখেই সামনে এগোতে হবে। সে রকম কোনো জায়গায় পৌঁছানোর পথ কি খোলা আছে?

জাহেদ উর রহমান

নির্বাচনের আগে কিছু সংস্কারের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, তা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। বিএনপির বক্তব্য খেয়াল করুন। হাসিনার পলায়নের পর সরকার গঠনের আগেই বিএনপি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করেছিল। নানা সমালোচনার পর তারা চুপ হয়ে যায়। এরপর সালাহউদ্দিন সাহেব দেশে ফিরে ছয় মাসের কথা বললেন। তারপর সেখান থেকে সরে গিয়ে তারা বলল, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাই। সম্প্রতি বিএনপি বলছে, আবার ৫ আগস্টের মতো মাঠে নামতে হবে। অর্থাৎ, সংস্কার প্রশ্নে নমনীয় অবস্থান থেকে তারা সরে এসেছে।

রুহুল কবির রিজভী বলছেন, গোয়েন্দা সংস্থা দল তৈরির চেষ্টা করছে। সতর্ক থাকলে বুঝতে পারবেন, এগুলো কথার কথা নয়। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে আর যা–ই হোক, নির্বাচনে যেন আমরা হস্তক্ষেপ না করি। ১৫–২০ বছর যদি অন্তত সুষ্ঠু নির্বাচন চলে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে। 

সাজ্জাদ শরিফ

আন্দোলনের সময় মানুষ যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন তাদের মধ্যে পুরোনো রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার প্রবল তাগিদ কাজ করেছিল। নতুন রাজনীতির জন্য তাদের তৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। সামনে কি ক্ষীণ হলেও কোনো আশার পথ আমরা দেখছি?

সলিমুল্লাহ খান

আমরা যদি গণতন্ত্র চাই, তাহলে রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে তো সেটা হবে না। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তার মধ্যে বিএনপি–জামায়াত–বাম নানা রাজনৈতিক শক্তি ছিল। কেউ একা ছিল না। তবে মূল শক্তি ছিল ছাত্র ও
জনতা। তাদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলে সেটাকে স্বাগত জানানো উচিত। প্রশ্ন হলো, নতুন দল গড়ে উঠছে কীভাবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দিয়ে দল করলে তো হবে না। পুরোনো স্বৈরাচারের সঙ্গে যুক্ত লোকদের দিয়ে তো হবে না।

আমি ডা. জাহেদ উর রহমানের সঙ্গে একমত। আমরা নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার চাই। শেখ হাসিনাকে বিদায় করার মানে হচ্ছে তিনি যে যে কারণে নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন, সেগুলো নিশ্চিহ্ন করতে হবে। আমাদের বিদ্যুৎ, ব্যাংক বা গণমাধ্যমের জগতে যে শক্তিবলে তিনি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলোর অবসান ঘটাতে হবে। বিশ্বায়নের সুযোগে বাংলাদেশ থেকে অতি সহজে টাকাপয়সা পাচারের পথ রোধ করতে হবে। আমার আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকার এসবে কোনো হাত দিচ্ছে না। সম্ভবত ভয় পাচ্ছে, হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। আমি দুঃখিত যে মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে আমি আশাবাদী হতে পারছি না।

আহমদ ছফাকে উদ্ধৃত করে বলি, মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে যে যুক্তিতে সমর্থন করেছিলাম, একই যুক্তিতে শেখ হাসিনার বিচারকেও সমর্থন করি। কারণ, শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের নামে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্ক্ষা যে মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার তা ব্যাহত করে তিনি অবিচার ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, মানুষের মর্যাদা লুণ্ঠন করেছেন।

আগামী ২৫ বছরে পরবর্তী সরকারগুলো কী করবে, তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা দরকার। শুধুমাত্র অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এটা পারবেন না। রাজনৈতিক দল ছাড়া যেহেতু রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলবে না, সে কারণে নির্বাচনের সংস্কার চাইলে রাজনৈতিক দলের ভেতরেও সংস্কারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইচ্ছা থাকলে এটা করা সম্ভব। ইচ্ছা কেন নাই? কারণ সবাই পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়।