মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজে দেশে ফিরলেন ১৭৩ বাংলাদেশি
মিয়ানমার নৌবাহিনীর ‘চিন ডুইন’ জাহাজে করে কক্সবাজার শহরে ফিরেছেন ১৭৩ জন বাংলাদেশি। দীর্ঘ দেড় থেকে দুই বছর তাঁরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) কারাগারে বন্দী ছিলেন।
আজ বুধবার বেলা সোয়া একটার দিকে গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ মিয়ানমারের জাহাজ থেকে ১৭৩ জনকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আরেকটি জাহাজে তুলে শহরের বাঁকখালী নদীর বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে আনা হয়। এরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ইমিগ্রেশনের জন্য সবাইকে একটি প্যান্ডেলের ভেতরে রাখা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাঁদের নিজ নিজ থানার মাধ্যমে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে মর্মে জানা গেছে। ১৭৩ জনের মধ্যে ৩ জন নারীও রয়েছেন। তাঁদের বাড়ি বান্দরবান সদরে।
ঘটনাস্থলে ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু ও ঈদগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল। তিনি বলেন, সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমারের কারাগারে বন্দী ১৭৩ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যাঁদের ইতিমধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম বলেন, ফেরত আসা ১৭৩ বাংলাদেশিকে প্রথমে বিজিবি গ্রহণ করে পুলিশকে হস্তান্তর করবে। যাচাই-বাছাই শেষে ১৭৩ জনের সবাইকে পুলিশের মাধ্যমে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে মিয়ানমারের জাহাজে করে আসা দেশটির একটি প্রতিনিধিদল বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট থেকে সড়কপথে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে গেছে। সেখানে ১১ বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ও সীমান্তরক্ষী বিজিপি সদস্য। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে। কাল বৃহস্পতিবার সকালে একই জাহাজে করে ২৮৫ জন সেনা ও বিজিপি সদস্যকে নিয়ে সিথুয়েতে ফিরে যাবে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল।
দুপুর ১২টার দিকে বাঁকখালী নদীর বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনা লোকজনকে গ্রহণ করতে ভিড় করেছেন টেকনাফ, নীলফামারী, বান্দরবানসহ বিভিন্ন এলাকার শতাধিক নারী-পুরুষ। বেলা সোয়া একটার দিকে নৌবাহিনীর জাহাজে করে ১৭৩ জনকে বাঁকখালী নদীতে আনা হলে স্বজনদের মধ্যে হইচই শুরু হয়। দেড়টার দিকে জাহাজ থেকে ১৭৩ জনকে জেটিতে নামিয়ে খোলা মাঠে তৈরি একটি প্যান্ডেলের নিচে রাখা হয়। প্যান্ডেলটি বিজিবি ও পুলিশ ঘিরে রেখেছিল। সেখানে সাংবাদিক ও স্বজনদের কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। প্যান্ডেলের ভেতরে ১৭৩ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু করে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একাধিক টিম। সঙ্গে চলেছে পুলিশ ইমিগ্রেশনের কাজ। কিছুটা দূরে সড়ক ও খোলা জায়গায় স্বজনেরা অপেক্ষা করেছেন। ফিরিয়ে আনা ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, তাঁদের হস্তান্তর করা হয়েছে তখনই।
দুই ছেলে সাইফুল ও ইসহাককে গ্রহণ করতে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া থেকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর জেটিঘাটে এসেছেন মা রেদওয়ান বেগম। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে সকাল ১০টা থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বেলা সোয়া দুইটার দিকে দুই ছেলে যখন এগিয়ে আসছিলেন, মা দৌড়ে তাঁদের ঝাপটে ধরে শুরু করেন কান্নাকাটি। রেদওয়ান বেগম (৫৫) বলেন, ২০২২ সালের ১৫ মার্চ বিকেলে বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে টেকনাফের জালিয়াপাড়ায় ফেরার সময় নাফ নদী থেকে ১৮ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় বিজিপি। এরপর ১ জুন পতাকা বৈঠকে চার কিশোরকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হলেও অপর ১৪ জেলেকে সিথুয়ের কারাগারে পাঠানো হয়। টানা দুই বছর কারাভোগ করার পর ১৪ জেলেকে আজ ফিরিয়ে আনা হয়। এর মধ্যে তাঁর দুই ছেলেও রয়েছেন।
১৭৩ জনের মধ্যে রয়েছেন নীলফামারীর সৈয়দপুর থানার বাসিন্দা হামজা (৩৫)। বাঁকখালীর জেটিঘাটে হামজাকে নিতে এসেছেন বড় ভাই ও ভ্যানচালক মানিকুল ইসলাম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট হামজা।
মানিকুল জানান, ছোট ভাই হামজা মানসিক ভারসাম্যহীন। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে সে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। এর পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল।
কয়েক দিন আগে নীলফামারী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মানিকুল জানতে পারেন, তাঁর ভাই হামজা মিয়ানমারে কারাগারে বন্দী ছিল। আজ নৌবাহিনীর জাহাজে তাঁকে কক্সবাজার আনা হচ্ছে। ভাইকে গ্রহণ করতে তিনি সকাল থেকে জেটিঘাটে অপেক্ষা করছেন। হাতে ভাইয়ের ছবি। কিন্তু বেলা দুইটা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে হামজার দেখা হয়নি।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ১৭৩ জনের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ১২৯ জন, বান্দরবানের ৩০ জন, রাঙামাটির ৭ জন, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার ১ জন করে আরও সাতজন রয়েছেন।