২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কী দিতে পারে

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পরম্পরায় আমরা পৌঁছেছি বিজয়ের মুহূর্তে। যুদ্ধের ৯ মাসের নানা ঘটনা এবং ঘটনার বিশ্লেষণ এখনো নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে আমাদের। আর মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পর্যালোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে দেখতে চায় বাংলাদেশকে—এ সংখ্যায় আছে অতীত আর বর্তমানের এক অনন্য যুগলবন্দী।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির পাঁচ দশকের পরও যদি এ রকম একটি প্রশ্ন অনেককে তুলতে দেখি—এ সময়ের তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে আর কী গ্রহণ করতে পারে? তাহলে বুঝতে হবে এর প্রাসঙ্গিকতা এখন আর স্বতঃসিদ্ধ বলে বিবেচিত নয়, যেন এর যা দেওয়ার, তা অনেক আগেই নেওয়া হয়ে গেছে, এখন এই গৌরবের ইতিহাসটাকে জাদুঘরে রেখে দিলেই চলে। একাত্তর নিয়ে কথা বললে এখনো অনেক তরুণ শোনে, কিন্তু সেই শোনায় তেমন মনোযোগ থাকে না, অথবা থাকলেও অতীতচারী না হওয়ার একটা সিদ্ধান্ত থেকে তারা বলে, অতীত নিয়ে পড়ে না থেকে ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, এর গত কুড়ি বছরের অর্থনৈতিক উন্নতি চমকপ্রদ। সে জন্যই কি না জানি না, সবাই ব্যস্ত ভবিষ্যতের দিকে চোখ মেলে রাখতে। যদি সত্যি সত্যি তা–ই হতো যে আমরা অতি দ্রুত ভবিষ্যতের রাস্তায় এগোচ্ছি এবং এক একটা বিশাল অর্জনের আর উল্লম্ফনের চিহ্নরেখা অতিক্রম করে যাচ্ছি, তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু ভবিষ্যৎবিহারী আমরাই তো সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় উগ্রতার মধ্যযুগে একটা পা রাখতে চিন্তাভাবনায় অনগ্রসর অতীতেই পড়ে থাকতে ব্যগ্র। তাহলে? শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলাটাই যদি অতীতচারিতার উদাহরণ হয়ে পরিত্যাজ্য হয়, মনের মধ্যে মধ্যযুগীয় অন্ধকার নিয়ে চলা মানুষেরা কেন তাহলে পরিত্যাজ্য হন না? কেন তাদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে?

যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের এক বিশাল অংশ এখন পরলোকে; আর ৩০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা বলতে কেউ বেঁচে থাকবেন না। ফলে এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী বলে কাউকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যোদ্ধারা না থাকলেও যুদ্ধের স্মৃতি থাকে। এমনকি প্রথম বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতো মহা ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিও আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মনে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মতো এক বিশাল সৃষ্টিযুদ্ধের স্মৃতি কেন হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে হবে? কেন তা বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের মনে খোদাই হয়ে থাকবে না? আফ্রিকায় ১৯৬০–এর দশকে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশে রাজনীতি হারিয়ে গেছে, গণতন্ত্র উধাও হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন অথবা দেনদরবার করেছেন, সে রকম মানুষদের কথা স্কুলের শিশুরাও জানে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বাতিল করে নির্বাচনে তাঁকে জয়ী ঘোষণা করে ক্ষমতায় বসানোর দাবি তুলেছেন সাবেক হয়ে যাওয়া এক প্রেসিডেন্ট। অথচ তাঁর দলের মানুষজনই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ২৩৩ বছরের পুরোনো সংবিধান মাথায় তুলে রাখতে হবে। বাতিলের দাবি অরাজকতার নামান্তর, একে বরং আমাদের দেশের ৫১ বছরের পুরোনো মুক্তিযুদ্ধকে নিজের মতো করে লিখে ফেললেও কোনো শক্তিশালী দলনেতাকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করি না, মাথায় তুলে রাখি বরং। আর কোনো শক্তিশালী নেতা সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে এর চরিত্র বদলে ফেললেও তাঁকে আমরা নায়কের আসনে বসাই।

মুক্তিযুদ্ধ একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছে, একটি পতাকা দিয়েছে। এর সঙ্গে আরও দিয়েছে কিছু আদর্শ, কিছু মূল্যবোধ, কিছু শিক্ষা। এর সবই তো সব সময় সব প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে, প্রতিপালন করতে হবে, চর্চা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে আমরা কী নিতে পারি—প্রশ্নটি ৫১ বছর আগে করা হলে যেমন বলা যেত, ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত, ক্ষুদ্র-বৃহৎ জাতিসত্তানির্বিশেষে সব মানুষের ঐক্য, মানবিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা, ন্যায্যতা, সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের সমান স্বাধীনতা, বৈষম্যহীনতা, সব মানুষের সমানাধিকার—এখনো সেই একই উত্তরই তো দেওয়া হবে। এর কোনোটিই তো পরিত্যাজ্য নয়। তাহলে কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা উঠলে অতীতচারিতার প্রসঙ্গটি আসে, কেন তা ভবিষ্যতের পথনির্দেশক বলে অভিনন্দিত হয় না?

এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হওয়াটা জরুরি, তা না হলে এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কী দিতে পারে—এটি একটি রুটিন প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে, জরুরি কোনো জিজ্ঞাসা হয়ে আমাদের সক্রিয়তার মাঝখানে জায়গা করে নেবে না।

ওপরের প্রশ্নটি জটিল, নিষ্পত্তিও সহজ নয়। মোটা দাগে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বাধীনতার পর কয়েক বছর যে আবেগ, উত্তেজনা, আকাঙ্ক্ষা আর স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, তা অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার মূলে আছে রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করেছে বাঙালির আড়াই দশকের প্রতিবাদী, উপনিবেশবিরোধী, স্বাধিকারকামী এবং জনমুখী রাজনীতি। এই রাজনীতির ভিত গড়ে দিয়েছিল গণমানুষের অধিকার আদায়ের ও রক্ষার অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক মুক্তির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, সংস্কৃতি ও বাঙালির চিরকালের ঐতিহ্যচিন্তায় আস্থা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর গণমুখী শিক্ষার দাবি। এই রাজনীতিতে প্রায় সবাই আস্থা রেখেছিলেন।

এঁরা ছিলেন উদারপন্থী, ওঁদের বিশ্বাস ছিল সবার অন্তর্ভুক্তিতে। কিন্তু এর পাশাপাশি রাজনীতির আরেকটি ধারা ছিল, যার চরিত্র ছিল অনুদার এবং রক্ষণশীল। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ঐক্যের আড়ালে সেই বিভাজন কার্যকর ছিল। রক্ষণশীল অংশটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, স্বজাতি হত্যায় পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে। যুদ্ধটা আরও বছর তিনেক চললে এরা একটা বড় শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত।

মুক্তিযুদ্ধের পরও সেই মনোভাব হারিয়ে যায়নি, আড়ালে চলে গিয়েছিল শুধু। এই ৫১ বছরে তারা সংগঠিত হয়েছে, শক্তি সঞ্চয় করেছে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সবচেয়ে দুঃখজনক যা, অসংখ্য তরুণের মন তারা দখল করে নিয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো গর্ববোধ করে না, নিজেদের গৌরবের ইতিহাস যারা বিশ্বাস করে না, এই পক্ষটিতে এখন পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীও আছেন। ওদের বৃদ্ধি ঘটেছে উদারবাদী পক্ষটির নিষ্ক্রিয়তা, আত্মতুষ্টি আর নানান স্ববিরোধিতার জন্য।

এক পক্ষের সক্রিয়তা, অন্য পক্ষের আত্মতৃপ্তির ঘুমে যাওয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে ইতিহাসে ঠাঁই নিতে যাচ্ছে, তার একটি উদাহরণ শুধু দিই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে যে কথাটি একসময় আমরা বলতাম এবং ধরে নিতাম, এটি কোনো বিমূর্ত চিন্তা নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের প্রতিফলনে তৈরি উদ্দীপক একটি শক্তি, এখন এক বিতর্কিত শব্দ। একটি পক্ষ এর অতিব্যবহার করে একে একটা অতিশয়োক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেল, অন্য পক্ষ একে মশকরার একটা হাতিয়ার হিসেবে নিল।

এখন রক্ষণশীলেরা ‘চেতনাপন্থী’ কথাটিকে একটা গালির মতো করে বলেন। অথচ এটি হওয়ার কথা ছিল এক ইতিবাচক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত এক ইচ্ছাশক্তি, যা দিয়ে দেশটাকে আমরা সব মানুষের জন্য তৈরি করে দেখতাম, যে দেশে আমাদের প্রত্যাশাগুলো বাস্তবে রূপ নিত। যেন এ দুই দলের মধ্যে ‘চেতনাপন্থী’ আর ‘চেতনাবিরোধী’ বলে চালাচালির গালি হিসেবে চেতনার অবস্থান।

২.

মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা এর আদর্শকে ধরে রাখিনি এবং কোনো কোনো সময় এর বিপরীতে হেঁটেছি বলে এই আদর্শকে অস্বীকার করা যায় না। এর চেতনাও তারিখসংবলিত হয়ে বাতিল হয়ে যায় না। যা দরকার, তা হচ্ছে এদের পুনরুদ্ধার।

এই পুনরুদ্ধারের কাজ কে করবে, এটিই হবে বড় কথা। আমি আশাবাদী বলে বিশ্বাস করি, এটি সম্ভব। এক সময় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জানাবে, আশাবাদী হওয়ার প্রেরণা দেবে। একাত্তরে কোনো কোনো দিন গেছে সবার জীবনেই যে দিনটিতে শুধু বেঁচে থাকাটাই যেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা বলে মনে হয়েছে। সেসব দিনও মুক্তিযুদ্ধ অর্থবহ করে দিয়েছে। এখন যে কঠিন সময় আমরা পার করছি, যে আত্মবিধ্বংসী আয়োজন দেখছি চারদিকে, যে আত্মঘাতী যুদ্ধের হুংকার শুনছি, সেসবও দীর্ঘস্থায়ী হবে না, যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধে একবার ফিরে যাই।

অনেকেই হয়তো বলবেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের এ আশাবাদ সময়নির্দিষ্ট, এখন সেটি অচল। কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করি, এই আশাবাদের ভিত্তি আছে, আর এ ভিত্তিটা কৃষক-শ্রমিক–মেহনতি মানুষ, যাঁরা এর শক্তি জোগান দিয়ে চলেছেন। তাঁরা রাজনীতি করেন না, তাঁরা শুধু একটা সহনীয় বর্তমান এবং সুন্দর আগামী চান। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কী দিতে পারে, এই প্রশ্ন করলে একটা উত্তর হতে পারে, এই পরিশ্রমী মানুষগুলোর সততা এবং আশাবাদ।

৩.

মুক্তিযুদ্ধ পুরোনো হবে না, জাদুঘরেও যাবে না। এর যা দেওয়ার, তা–ও তারিখনির্দিষ্ট হয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পক্ষ-বিপক্ষ ছিল, এখনো রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ আছে, কিন্তু বাংলাদেশ যতই এগোবে, মানুষ দেখবে, নিজেদের ইতিহাস সে আস্থা রেখে চললে চলাটা আমাদের সহজ হবে।

৪.

এ মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধ থেকে আমরা দেশপ্রেমের প্রয়োজনীয়তার কথাটা নিতে পারি, শহর-গ্রাম, এলিট-দলিত বিভাজনের অসারতার বিষয়টি শিখতে পারি। তরুণদের গড়ার শক্তিতে বিশ্বাস রাখতে পারি। ঐক্য এবং উদার মানবিকতার পাঠগুলো নিতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধ আগেও দিয়েছে, এখনো দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, আমরা কি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। নাকি বিভাজনের রাজনীতির চূড়ান্তটা দেখার জন্য আমরা দুই ভাগ হয়ে দুই দিকে বসে আছি? বিভাজনেই কি মুক্তি, নাকি ঐক্যে, যা একাত্তরে আমাদের এক কঠিন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রেরণা দিয়েছিল?

উত্তরটাও খুব দূরে নেই: উত্তরটা আসে দেশপ্রেমের রাস্তা ধরে। সেটি থাকলে রাস্তাটা আর বন্ধুর থাকে না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: লেখক ও শিক্ষাবিদ।