জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিরপ্রস্থান জাতির অপূরণীয় ক্ষতি
১২ এপ্রিল মধ্যরাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে আপনাদের অনেকের মতো আমিও গভীরভাবে শোকাহত। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি, বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় যত দূর মনে পড়ে ষাটের দশকের প্রথম ভাগে। ওই সময় তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। সে সময়ের অন্যতম প্রধান ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা ছিলেন। আমি নিজেও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম। সে হিসেবে মাঝেমধ্যে তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হতো। ওই সময় থেকেই আমার মনে হয়েছে যে ডা. জাফরুল্লাহ একজন নিঃস্বার্থ ও ত্যাগী মানুষ, যিনি পরহিতব্রতেও সমান আগ্রহী।
এরপরের কাহিনি প্রায় সবারই জানা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বিলাতে প্রায়-সমাপ্ত উচ্চতর চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য বিলাত ত্যাগ করেন। ভারতের ত্রিপুরায় গড়ে তোলেন ফিল্ড হাসপাতাল। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের সূত্রে তিনি পরিচিত হন জেনারেল ওসমানী এবং কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে। এ সময় আমি মুক্তিযুদ্ধের অংশ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকল্পে যুক্ত থাকলেও ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।
গত শতকের আশির দশকের শুরুতেই ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে আমার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হলো। আমি তাঁকে জাফর ভাই বলে সম্বোধন করতাম, আর তিনি আমার নামের প্রথম অংশ ধরেই সম্বোধন করতেন। সে সময় জাফর ভাইয়ের উদ্যোগে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ (হেলথ ফর অল) নামের একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, ফরহাদ মজহার, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, ড. আজিজুর রহমান, অধ্যাপক মোহম্মদ ইব্রাহিম, সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী, অধ্যাপক মনসুর মুসাসহ আরও কয়েকজন। আমি নিজেও সক্রিয়ভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হই। সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জাফর ভাই এবং অন্য সদস্যদের পীড়াপীড়িতে আমি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি সর্বজনীন গণমুখী স্বাস্থ্য আন্দোলন। এটি ছিল বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর নির্বিচার, লুণ্ঠন ও শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা একটি জাতীয় আন্দোলন। আমাদের এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারীদের অভাব ছিল না। তৎকালীন দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এতে ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী মহল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তবে আমরা আমাদের সংকল্পে অবিচল থাকি। জাফর ভাইসহ আমাদের কারও কারও বিরুদ্ধে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু জাফর ভাইয়ের অদম্য সাহস আমাদের কর্তব্য থেকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করতে পারেনি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ আন্দোলন বিশেষ পরিপূরক ভূমিকা পালন করে।
জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এক অনন্য কীর্তি—এ কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। এই নীতি প্রণয়নকালে তিনি আমিসহ অন্যদের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। ওষুধনীতির মূল দর্শন ও অভিলক্ষ্য ছিল, দেশীয় ওষুধশিল্পের সুষ্ঠু বিকাশের মধ্য দিয়ে স্বল্প মূল্যে জনসাধারণের কাছে ওষুধ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। আজ আমি অকুণ্ঠচিত্তে এ কথা বলতে চাই যে আজ বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে,Ñতার মূল প্রণোদনা ও ভিত্তি হচ্ছে জাতীয় ওষুধনীতি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইতিমধ্যে আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অনেক কর্মসূচির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হই। গণস্বাস্থ্যের এসব কর্মসূচির কোনো কোনোটিতে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ও অধ্যাপক আহমেদ কামাল।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে একটি দর্শনের ওপর। জাফর ভাইয়ের এ দর্শন ছিল, এ দেশের অসংখ্য দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বেশ কয়েকটি গণমুখী কার্যক্রম গ্রহণ এবং এ-সংক্রান্ত সভা–সেমিনারের আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে আমার যোগদান করার সুযোগ হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কার্যক্রমে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী। তিনি ছিলেন জাফর ভাইয়ের দক্ষিণ হস্ত এবং অন্যতম প্রধান সহযোগী। অন্যজন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন ডা. মোর্শেদ চৌধুরী। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গণমুখী মডেল পৃথিবীর কোথাও কোথাও প্রবর্তন করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে জাফর ভাই দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশাপাশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। এ দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, মানবসেবা। সারা বিশ্বে ড. ইউনূস যখন বহু সম্মানে ভূষিত ও সমাদৃত, ঠিক তখনই তিনি নিজ দেশে অবহেলিত ও নিগৃহীত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একদিন তিনি তাঁর স্বদেশে প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত হবেন।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ‘গণবিশ্ববিদ্যালয়’ নামক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পূর্ণকালীন সদস্য। গণবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। তৎকালীন কমিশন চেয়ারম্যান গণবিশ্ববিদ্যালয় নামটি গ্রহণ করতে চাননি; নামই একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জাফরুল্লাহ ভাই এতে অসন্তুষ্ট হন। আমি জাফর ভাইয়ের পক্ষে গণবিশ্ববিদ্যালয় নামেই অনুমোদন প্রদানের জন্য চেয়ারম্যানের ওপর চাপ সৃষ্টি করি। শেষ পর্যন্ত এর ইংরেজি নাম ‘পিপলস ইউনিভার্সিটি’ নামে অনুমোদন দিতে তিনি সম্মত হন। এভাবেই গড়ে ওঠে জাফর ভাইয়ের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়Ñগণবিশ্ববিদ্যালয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান লিখে শেষ করার মতো নয়। তাঁর প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ের অবতারণা করে আমি নিবন্ধ শেষ করব।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, সত্যানুসন্ধানী ও অকুতোভয় কর্মবীর। ছিলেন দ্বিধাহীন স্পষ্টভাষী। তাঁর এই পরিচয় আরও পরিস্ফুট তাঁর জীবনের শেষপাদে। গত ১০ বছরে তিনি আমাদের জাতীয় জীবনে আবির্ভূত হন একজন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে। এই প্রতিবাদ ছিল অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সমাজ পরিবর্তন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জাতীয় আন্দোলনে জাফর ভাই নিজেকে উৎসর্গ করেন। নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের সপক্ষে তিনি ছিলেন অতিশয় সোচ্চার। তাঁর এই সক্রিয় ভূমিকার জন্য নিজেও নির্যাতিত হয়েছেন। অন্যায়–অবিচারের আন্দোলন সংগ্রামকারী যেকোনো সংগঠনের আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়েছেন। এ সময় আমি নিজেও তাঁর সঙ্গে কোনো কোনো সভায় উপস্থিত থেকেছি এবং বক্তব্য দিয়েছি। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পরিবর্তনপ্রত্যাশী। আমার সঙ্গে দেখা হলেই জাফর ভাই রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পরিবর্তনের পথরেখা, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয়Ñইত্যাদি বিষয়ে মতবিনিময় করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা তাঁকে একটি অনন্য অবস্থান প্রদান করে। পরিতাপের বিষয়, পরিবর্তনের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা হয়তো আসন্ন, তবে দুঃখের বিষয়, তা তিনি দেখে যেতে পারলেন না।
একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে এই রচনা শেষ করব। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এবং কবি আবদুল হাই শিকদার জাফর ভাইয়ের বাসায় যাই। জাতীয় জীবনে তাঁর অবদানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমি বলি, ‘জাফর ভাই, আপনার আরও দীর্ঘদিন থাকতে হবে আমাদের মধ্যে।’ আমি আরও বললাম, ‘এ জন্যই বিদেশে গিয়ে আপনার কিডনি প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন।’
তিনি একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার নাম ধরে বলে উঠলেন,Ñ‘আমরা কি সারা জীবন সর্বসাধারণের চিকিৎসার জন্য সংগ্রাম করিনি? আজ আমি কীভাবে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেব?’
আমরা স্তব্ধ হয়ে রইলাম। আমাদের স্তব্ধতার মধ্য দিয়েই বাংলার এক মহীরূহ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন অনিবার্য প্রস্থানের পথে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।