রাজধানী ঢাকার সবই কম-বেশি বদলায়। কিন্তু বদলায় না শুধু বাসযাত্রীদের ভোগান্তি–বিড়ম্বনা। আসলে রাজধানীবাসীর দুর্ভাগ্য যেন ঢাকার বাসের যাত্রী হওয়া। নোংরা, জীর্ণশীর্ণ বাসে গাদাগাদি করে যাতায়াত। বাড়তি ভাড়ার নৈরাজ্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহনশ্রমিকদের ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে হত্যার মতো ঘটনা।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে সরকার বাসের ভাড়া বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই ভাড়ার হার মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ নেই। বরাবরের মতো ইচ্ছেমতোই ভাড়া আদায় চলছে নগর পরিবহনে। দুর্মূল্যের বাজারের আগুনে নাভিশ্বাস মানুষ যখন এর প্রতিবাদ করছেন, তখনই তাঁদের আক্ষরিক অর্থেই গলা ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে।
এর সর্বশেষ ঘটনা গত শনিবার সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সরণিতে। সেখানে প্রাণ গেছে আবু সায়েম নামে এক বাসযাত্রীর। যে বাসে উঠে তিনি কর্মস্থল মতিঝিল থেকে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বাসায় ফিরছিলেন, সেটা থেকে নামার পর ওই বাসেরই পেছনের চাকায় মাথা পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে স্বজনেরা বলছেন, বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় সায়েমকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দেন ৮ নম্বর রুটের বাসটির চালকের সহকারী। সায়েম মতিঝিলে একটি পোশাক কারখানার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ভাড়া কিংবা অন্য কোনো কারণে কথা-কাটাকাটির জেরে যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে গাজীপুর মহানগরের শিববাড়ী এলাকায় বাসভাড়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে চলন্ত বাস থেকে সায়েম নামের এক যাত্রীকে ফেলে হত্যার অভিযোগ ওঠে। গত জানুয়ারিতে ঢাকার ওয়ারীর জয়কালী মন্দিরের সামনে ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে ইরফান আহমেদ নামের এক যাত্রীকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে এক টাকা ফেরত চাওয়ায় জসিম উদ্দিন নামের এক যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যার দায় কার? শুধুই কি পরিবহনের চালক কিংবা শ্রমিকের? এখানে কি সরকারের কোনো দায় নেই?
আসলে সরকারই পরিবহন খাতে ভাড়া নৈরাজ্য বহাল রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে। পরিবহন খাতে আরেকটি বড় সংকট চাঁদাবাজি। এই সংকটে সাধারণ যাত্রীদের কোনো দায় নেই। অথচ তাদেরই বাড়তি ভাড়া পরিশোধের মাধ্যমে এই অনিয়মের ঘানি টানতে হয়। পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় এবং চাঁদাবাজির রাশ টানতে ডিজিটাল ভাড়া আদায়পদ্ধতিকে কার্যকর বিকল্প হিসেবে মনে করা হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সাফল্যের কৃতিত্ব দাবি করে সরকার। কিন্তু পরিবহন খাতে ডিজিটালের ছোঁয়া লাগেনি বলা চলে।
ঢাকায় মানুষ যত যাতায়াত করে, এর ৬৭ শতাংশই হয় বাস-মিনিবাসে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, বর্তমানে ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় আট হাজার বাস-মিনিবাস চলার অনুমতি আছে। তবে পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, এই সংখ্যা বাড়ে-কমে। অনেক কোম্পানি অনুমোদনের চেয়ে বেশি বাস চালায়। আবার অনেক কোম্পানি অনুমোদন নিয়ে বাস নামায়নি। কম-বেশি ছয় হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে।
এই স্বল্পসংখ্যক বাসেই ডিজিটাল ভাড়া আদায় পদ্ধতি চালু করতে পারেনি সরকার। রাজধানী ঢাকায় বড় বড় ভবন বেড়েছে। ভবনে এসেছে চাকচিক্য। অফিস-আদালতে নানা ডিজিটাল সুবিধা যুক্ত হয়েছে। সরকারি দপ্তরে চালু হয়েছে ডিজিটাল হাজিরা। যানবাহনের নম্বরপ্লেট ও মালিকানার ব্লু-বুকসহ কম দরকারি বিষয় ডিজিটাল করতে বিপুল টাকা ঢেলেছে সরকার। গ্রাহকদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের ফি নিচ্ছে। কিন্তু যানবাহন পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও ভাড়া আদায় রয়ে গেছে সেকেলে।
ঢাকার গণপরিবহনের ভাড়া স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আদায় এবং তা সমন্বয়ের জন্য ২০১৪ সালে জাইকার সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্লিয়ারিং হাউস। স্মার্টকার্ড কিংবা র্যাপিড পাস ব্যবহার করে যাত্রীরা এই ব্যবস্থায় ভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন বাস-ট্রেনসহ যেকোনো গণপরিবহনে। সেই ভাড়ার অর্থ জমা হবে ক্লিয়ারিং হাউসে। তখন ৬০ হাজার র্যাপিড পাস এবং এ-সংক্রান্ত যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছিল। বিআরটিসির কিছু বাসে এ ব্যবস্থা চালুও হয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেই ব্যবস্থার কিছুই দেখা যায় না।
বিশ্বের বেশির ভাগ বড় শহরে এখন পরিবহনে চড়তে হাতে হাতে ভাড়া দেওয়ার প্রচলন নেই বললেই চলে। মাস, এমনকি বছরওয়ারি র্যাপিড পাস বা বিশেষ কার্ড কিনছে মানুষ। এর মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করা হয়। বাংলাদেশে সাত বছরেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর কিছু কিছু রুটে ই-টিকিটিং চালু করে। প্রথমে এ পদ্ধতি চালু হয় মিরপুর ১২ থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চলাচলকারী ট্রান্স সিলভা পরিবহনে। অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় তারা এখন এই ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন নতুন করে কিছু বাসে ই-টিকিটিং চলছে।
তবে পরিবহন মালিকেরা যেটিকে ই-টিকিটিং বলছেন, আদতে তা সে রকম নয়। নির্দিষ্ট কিছু বাস থামার স্থানে পরিবহন কোম্পানির লোকজন পজ মেশিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই মেশিনে বিআরটিএর ঠিক করে দেওয়া ভাড়ার হার সেট করা আছে। যাত্রীরা বাসে উঠার আগে নির্ধারিত ভাড়া দিলে একটা কাগজ প্রিন্ট করে টিকিট হিসেবে দেওয়া হয়। নামার সময় পরিবহন শ্রমিকেরা সেই টিকিটটি দেখে রেখে দেন।
পরিবহন মালিকেরা বলছেন, এই পদ্ধতির কিছু সমস্যা আছে। নির্ধারিত স্থানের বাইরে থেকে পরিবহন শ্রমিকেরা বাড়তি যাত্রী উঠিয়ে নেন। এই টাকা মালিক পায় না। এ ছাড়া পজ মেশিন নিয়ে টিকিট বিক্রি করার মতো অবকাঠামো রাস্তার পাশে নেই। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতাও করা হচ্ছে না।
কেন সরকার বা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বাসের ভাড়া আদায়ে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে পারছে না? তা অনুসন্ধানে অন্তত দুটি বড় কারণ পাওয়া যায়। ১. সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মূল নজর দেখা গেছে মেগা প্রকল্পে। বিশেষ করে পরিবহন খাতের অভিভাবক সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বড় সেতু, উড়াল সড়ক ও বিপুল টাকার চার লেন সড়ক নির্মাণে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এর বাইরে কেনাকাটা–সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোও গুরুত্ব পেয়েছে। ডিজিটাল ভাড়া আদায় ব্যবস্থা—কম বাজেটের, নিরবচ্ছিন্ন তদারকি দরকার। এ জন্যই হয়তো গুরুত্ব পায়নি।
২. পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ। ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৫০ জন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত। জেলা, উপজেলা ও টার্মিনালকেন্দ্রিক পরিবহন কমিটিগুলোর মূল নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাদের আয়ে টান পড়বে—এই সাহস সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দেখাবে না—এটাই স্বাভাবিক।
পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহনমালিক, শ্রমিক, স্থানীয় মাস্তান, রাজনীতিকদের নামে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। শুধু ঢাকাতেই বছরে প্রায় পৌনে ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা উঠে বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং এই খাতের সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহনশ্রমিকেরা নগদ টাকায় ভাড়া কাটেন। সেই টাকা আঙুলের ফাঁকে নিয়ে সারা দিন শহরময়, নগর ও গ্রামীণ পথে ঘুরে বেড়ান। ফলে তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়াটা সহজ হয়ে গেছে। কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা থাকলে নগদ টাকার লেনদেন কমে যেত। এতে চাঁদাবাজিও অনেকটাই কমে যেত।
এখন দেখার বিষয় সরকার প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবে নাকি যাত্রীদের বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া অব্যাহত রাখবে।