‘ইতালিফেরত পাত্রীর’ পোস্টে ক্লিক করলেই চলে যায় জুয়ার সাইটে
‘পাত্রের খোঁজে’ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টদাতা নিজের ‘পরিচয়’ দেন ইতালিফেরত তরুণী (২৯) হিসেবে। পোস্টে দাবি করা হয়, ইতালিতে চার বিঘা জমির ওপর তাঁর দোতলা একটি বাড়ি আছে। ইতালিতে তাঁর একটি কফি শপ রয়েছে। বিয়ের পর স্বামীকে তিনি ইতালি নিয়ে যাবেন।
আরও বিস্তারিত জানার জন্য পোস্টের কমেন্ট অংশে একটি লিংক দেওয়া হয়। লিংকে ‘ক্লিক’ করলেই চলে যাচ্ছে বিভিন্ন জুয়া, বিদেশি মুদ্রা বিনিময় ও ক্রিপ্টোকারেন্সির (ডিজিটাল বা ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা) সাইটে।
গত জুলাই থেকে বিভিন্ন ফেসবুক পেজে ‘ইতালিফেরত এই পাত্রীর জন্য পাত্রের সন্ধান’ চেয়ে অন্তত ৩৫টি পোস্টের সন্ধান পেয়েছে অরাজনৈতিক অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব। তারা দেখেছে, এসব পোস্টের বিষয়বস্তু প্রায় একই; যদিও কোনো কোনো পোস্টে বয়স, জমির পরিমাণ ও পাত্রীর ছবিতে ভিন্নতা রয়েছে।
ডিসমিসল্যাব গতকাল রোববার নিজেদের ওয়েবসাইটে এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেসবুকে ‘পাত্র চাই’ লেখা ৪৩০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করেছে ডিসমিসল্যাব। তারা দেখেছে, এ ধরনের পোস্টে ক্লিক করলে ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে জুয়া বা বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের সাইটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই প্রতারণার সঙ্গে শতাধিক ফেসবুক পেজ, প্রোফাইল, গ্রুপ ও সংগঠনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
৪৩০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, এগুলো (পোস্ট) ১১ হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মন্তব্য পড়েছে। পোস্টে ছিল দুই লাখের বেশি ‘রিঅ্যাকশন’। পোস্ট দেখে বহু মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। পোস্টের কমেন্টে অনেকেই যোগাযোগের তথ্য চেয়েছেন। অনেকে নিজেদের মুঠোফোন নম্বর দিয়েছেন যোগাযোগ করার জন্য।
যদিও কিছু মন্তব্যকারী এসব ভুয়া পোস্টের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তবে বড় একটা অংশই এ সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে সত্যিকারের আগ্রহ দেখিয়েছেন।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৪৩০টি পোস্টে ১০১টি সংক্ষেপিত লিংক রয়েছে। এক লিংক একাধিক পোস্টের নিচে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮২টি লিংক জুয়া বা বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সাইটে নিয়ে গেছে, যেখানে ব্যবহারকারীদের অর্থ আয় করার জন্য ক্লিক করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ছয়টি লিংক ছিল ক্ষতিকর। এ ছয় লিংকে ক্লিক করলে তথ্য চুরি হওয়া ও ক্ষতিকর সফটওয়্যারে (ম্যালওয়্যার) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। ১৩টি লিংক ক্ষতিকর ছিল না। ১০১টি লিংকের কোনোটিতেই পাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কোনো ধরনের তথ্য দেওয়া ছিল না।
‘পাত্রের সন্ধানে’ এসব পোস্টের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মডেল বা জনপ্রিয় নারী ব্যক্তিত্বের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
পোস্টের নিচে যুক্ত করা লিংকে ক্লিক করলে কোথায় নিয়ে যায়, তা দেখার চেষ্টা করেছে ডিসমিসল্যাব। এ রকম একটি পোস্টের নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করে দেখা যায়, ফরেক্স ট্রেডিং সাইট কোটেক্সে (Quotex) নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার ক্লিক করলে বাজি ধরার সাইট জিত-বাজে (Jit-baaj) নিয়ে যায়। এভাবে বিভিন্ন রকম বাজি ধরার সাইটে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডিসমিসল্যাব এ রকম কিছু বাজি ধরার বা জুয়ার সাইটের সন্ধান পেয়েছে। এর মধ্যে আরও রয়েছে ক্রিকিয়া, বাবু ৮৮, বাজি, সিক্স ৬ বিডি, সিক্স ৬ এসবিডিটি অনলাইন। বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সাইটের মধ্যে কোটেক্স ছাড়াও রয়েছে পকেট অপশন। প্রলোভনে পড়ে কেউ এসব লিংকে ক্লিক করলে আর্থিকভাবে লাভবান হয় প্রতারকেরা।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিময়, স্থানান্তর ও ব্যবসার অনুমোদন দেয় না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টে এ ধরনের লেনদেন অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গত বছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হুন্ডি, অনলাইন জুয়া, গেমিং, বাজি ধরা ও ক্রিপ্টো ব্যবসার বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধে উচ্চ আদালতও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রলোভন দেখিয়ে লিংকে ক্লিক করানো সাইবার জগতের পুরোনো কৌশল বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মঈনুল হোসেন। তাঁর পরামর্শ, কিসের জন্য লিংক, সেটা ভালোভাবে না বুঝে বা নির্ভরযোগ্য উৎস্য থেকে কেউ না দিলে, সেখানে ক্লিক করা উচিত নয়। কারণ, লিংক খুব ভয়ংকর, যার মাধ্যমে অনেক বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রতারণা থেকে সুরক্ষার উপায় বর্ণনা করে বি এম মঈনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বহু মানুষের সাইবার জ্ঞান নেই। তাদের পক্ষে ক্ষতিকর লিংক বোঝা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর নিজ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিক করে জুয়ার সাইটে চলে গেলেও সেখান থেকে ব্যবহারকারীকে নিজ উদ্যোগে ফিরে আসতে হবে। এ ধরনের পোস্ট প্রদানকারী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। আর পেমেন্টের জায়গায় দেশের কিছু এজেন্ট থাকে। তাদের বিরুদ্ধেও সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।