হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে, আন্তর্জাতিক তদন্ত দরকার: অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা হয়েছে। যাদের আমরা বলতে পারি প্রাইভেট বাহিনী। এর বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের জন্য অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক তদন্ত দরকার।’
সারা দেশে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন ইউল্যাবের শিক্ষকেরা। আজ বুধবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষকেরা এ সমাবেশ করেন। সেখানেই এ কথাগুলো বলেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি এ সময় সরকারকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে পদত্যাগের দাবিও জানান।
সমাবেশে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, সব সরকারি চাকরিতে সবার বৈধভাবে প্রতিযোগিতা করার অধিকার থাকবে কি থাকবে না, সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধানের দিকে না গিয়ে দেশের সরকার প্রথমে সেটাকে একপাশে ঠেলে দিতে চেয়েছে, উপেক্ষা করতে চেয়েছে ও পরে গিয়ে দমননীতি অবলম্বন করেছে নিজেদের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে। সেটা থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের শুরু।
রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালনের সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধী আখ্যা দিয়ে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘এখনো হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করার জন্য চেষ্টা করছে। গতকাল (মঙ্গলবার) শোক দিবসের নামে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সেখানে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের জন্য শোক পালনের জন্য কালো ব্যাজ পরিধান করতে বলেছেন। আমরা কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা লাল ব্যাজ পরেছি। তারপরও তাঁদের তাঁরা শহীদ বলতে রাজি নন। তাহলে তাঁরা যদি শহীদ না হন, তাঁরা যদি শুধু নিহত হন, তাঁদের জন্য তাহলে প্রার্থনা করার দরকার কী? এ ধরনের অজস্র স্ববিরোধী আপনারা পাবেন।’
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, ‘সরকার এখন এ হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য অজুহাত দিচ্ছে। তারা মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা করেছে, সেতু ভবনে হামলা করেছে অথবা বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে হামলা করেছে। আমাদের জ্ঞানী বিশ্লেষকেরা, যেমন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, তাঁরা পরিষ্কার করেছেন, এগুলোকে বলা হয় কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই)। এগুলো রক্ষার জন্য সরকার কোনো পূর্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি অথবা করলেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে এর দায় তাদেরই বহন করতে হবে।’
সরকারের ক্ষমা চাওয়ার পর্যায়ও পার হয়ে গেছে উল্লেখ করে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘কেউ কি বিশ্বাস করেন এ সরকারের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা এর (হত্যাকাণ্ডের) ন্যায়বিচার করতে পারে? তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। কারণ, তারা নিজেরাই হত্যাকারী। যারা নিজেরাই রাজাকার, তারা অপরকে বলে রাজাকার। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী আছে। মানে যারা খুনি, যারা বিশ্বাসঘাতক, তারা আমাদের বলে খুনি, বিশ্বাসঘাতক।’
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমরা আজকে শিক্ষক হিসেবে দাঁড়িয়েছি। শিক্ষকতার বাইরেও আমাদের সামাজিক ভূমিকা আছে। আমি আগে আত্মসমালোচনা করব। আমরা আমাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করিনি। আমাদের একটা ধারণা ছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েগুলো ফার্মের মুরগি। ওরা রাজনীতি করে না। রাজনীতি করতে উৎসাহিত করা হয় না। আমরা অবাক হলাম, যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি বাহিনীর হামলার ফলে সাধারণ ছাত্ররা জেগে উঠল তাদের বিরুদ্ধে, তারা যখন পরাজয়ের মুখে, তখন তাদের সরিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তখনই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে।’
নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘গুলিতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা আমাদের পথপ্রদর্শক। আমরাও মারা যেতে পারি, গ্রেপ্তার হতে পারি। আমরা বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে আছি। কিন্তু ভেসে যাওয়ার জন্য আসিনি। বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমাদের আত্মসমালোচনা দরকার। এই সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা দরকার। সংকটের উৎপত্তি কোথায়, সেদিকে না গিয়ে সরকার এখনো বলছে এই দল, সেই দলকে নিষিদ্ধ করব। সেটা শুধু সমস্যাকে আরও বাড়াবে। এ জন্যই এখন যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান।’
সমাবেশে মুখে লাল কাপড় বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবির প্রতি সমর্থন জানান। এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে দাবি করে এর বিচারের জন্য উপস্থিত শিক্ষকেরা আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানান। সমাবেশে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।