কিয়েভে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বাংলাদেশিরা কেমন আছেন
ছোট ছেলে কারিমকে সকালে ঘুম থেকে তুলে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হাবিবুর রহমান। তখন সকাল প্রায় সাতটা বাজে। হাবিব থাকেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিপ্রোস্কি এলাকায়। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের গাজীপুরে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি আছেন ইউক্রেনে। বিয়ে করেছেন ইউক্রেনীয় নারী ইলোনাকে। হাবিব-ইলোনা দম্পতির দুই সন্তানের ছোটটি কারিম।
গতকাল সোমবার সকালে যখন স্কুলের পোশাক পড়ছে কারিম, তখনই হঠাৎ হাবিবের মুঠোফোনে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। সেই সঙ্গে বাইরে বাজতে থাকে সাইরেন। সম্ভাব্য কোনো আক্রমণের আগে এখন ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সতর্ক করতে মুঠোফোনে অ্যালার্ম দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে সাইরেন বাজানো এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সতর্কবার্তা তো রয়েছেই।
হাবিবুর বলছিলেন, ‘মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দেওয়ার অর্থ হইলো, তোমরা সতর্ক হয়ে যাও। নিরাপদ আশ্রয় নাও। শুধু কিয়েভ না, ইউক্রেনের নানা জায়গায় প্রতিটি বাড়ির নিচে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা আছে। অ্যালার্ম বাজলে সেখানে চলে যেতে হয়।’
তবে হাবিবুর আর নিচতলায় যাননি। অ্যালার্ম বাজার পর এক ঘণ্টাও হয়নি, প্রকম্পিত হয়ে ওঠে তাঁর বাসস্থান নিপ্রোস্কি এলাকা। তাঁর বাড়ি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রথম একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এরপর একটি পানি সরবরাহকেন্দ্রে।
সেটিও তাঁর বাড়ির কাছাকাছি। অন্তত ছয়টি বড় আকারের বিস্ফোরণের শব্দ তাঁর কানে এসেছে বলে জানান হাবিব। তিনি বলছিলেন, ‘বিল্ডিং কাঁপতেছিল। বাচ্চাটা আমারে জড়ায়ে ধরে। রাশিয়া প্রথম দিন আক্রমণ করার পর যে অবস্থা হইছিল, এবারও তেমন হইল।’
যুদ্ধাবস্থার মধ্যে থাকলেও রাজধানী কিয়েভের অবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। স্কুল খুলে গিয়েছিল, বিপণিবিতান স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। রাস্তাঘাটে গাড়ির চলাচলও ছিল স্বাভাবিক।
গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ হামলার পর কিয়েভ ছেড়ে গিয়েছিল হাজারো মানুষ। তাদের অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছিল। এমনকি কিছু বাংলাদেশিও ফিরে এসেছে বলে জানান কিয়েভের নিভকি এলাকার বাসিন্দা আরেক বাংলাদেশি হাসিনুল হক। তাঁর জন্ম চুয়াডাঙ্গা জেলায়। দুই যুগের বেশি সময় ধরে হাসিনুল থাকেন নিভকিতে। এর অবস্থান রাজধানীর প্রায় কেন্দ্রস্থলে।
হাসিনুল বলেন, অন্তত ২০ জন বাংলাদেশি ফিরে এসেছেন গত কয়েক মাসে। তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তি দুই দিন আগে যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে এসেছেন। তারপরই এই হামলার মুখে পড়লেন।
হাসিনুল বলছিলেন, ‘কিয়েভ একেবারে প্রায় সেই আগের কিয়েভে পরিণত হয়ে গেছিল। মানুষের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে ভীতি বলতে কিছু ছিল না। আমরা ফেব্রুয়ারির সেই ভয়াবহতা ভুলে যেতে বসেছিলাম। কিন্তু সোমবারের হামলায় সেই স্মৃতি ফিরে এল।’
তবে হাসিনুলসহ বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে একটি বিষয় বোঝা গেল, ফেব্রুয়ারিতে রুশ হামলা শুরুর সময় যে ভীতি ছিল, এবারের হামলার পর সেটা ততটা ছড়ায়নি। হামলার পরপরই ছেলেকে নিয়ে পানি আনতে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন বলে জানান হাসিনুল। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বাইরে ছিলেন।
হাসিনুল বলছিলেন, ‘ইউক্রেনের মানুষের কাছে কেমন জানি মনে হচ্ছে, এসব হামলা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা ভয় ভুলে গেছি। এই যুদ্ধের মধ্যেও কিয়েভ ছাড়িনি। আর ছেড়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা নেই।’
গতকাল কিয়েভে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। হামলার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়। দোকানপাট ও রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নাগরিকদের পাঁচ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় কেনাকাটা বা প্রয়োজনীয় কিছু সেরে নিতে। সব দোকান না খোলা হলেও অনেকগুলোই খোলে বলে জানান হাসিনুল।
হামলার সময় কর্মস্থলে ছিলেন কিয়েভের পিচেয়েস্কি এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার। তাঁর বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। একটি সরকারি স্কুলে চাকরি করেন। ভোর পাঁচটার মধ্যেই তাঁকে স্কুলের উদ্দেশে বের হতে হয়। গতকালও তাই হয়েছিলেন। সকাল আটটার পর শুরু হয় তাণ্ডব। স্কুলভবনের নিচে থাকা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান তিনি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আগলে রাখেন শিক্ষক ও কর্মচারীরা মিলে। তাদের ভয় না পেতে বলা হয়। হামলার রেশ কমে আসতেই প্রত্যেক অভিভাবককে ডেকে তাঁদের হাতে সন্তানদের তুলে দেওয়া হয়।
আবদুল জব্বার যে এলাকায় থাকেন, সেখানে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ভবন ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস আছে। তাই সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বলে জানান তিনি। তাঁর এলাকার কাছাকাছি কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি বলে জানান জব্বার। তবে বিস্ফোরণের শব্দ ওই এলাকা থেকে শোনা গেছে।
বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটার পর থেকেই ইউক্রেনের সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় নাগরিকদের দেওয়া সরকারি নানা ধরনের সহযোগিতার কথা প্রায় সব বাংলাদেশিই বললেন। ৫১৪৬ নামের একটি হেল্পলাইন নম্বর আছে। সেখানে ফোন করলে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা মেলে, বলেন জব্বার। তিনি বলেন, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, অসুস্থ বা প্রতিবন্ধীদের কোনো প্রয়োজন হলে দ্রুত সাড়া মেলে।
এসব ব্যক্তিকে জরুরি প্রয়োজন হলে কারফিউয়ের মধ্যেও বাইরে নিতে অসুবিধা হয় না। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে কলের পানি বা টয়লেট নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো সারাইয়ের দরকার হলেও সহযোগিতা মেলে।
গতকালের হামলার পর রাস্তায় যাতায়াতে কড়াকড়ি আরও বাড়ে। তবে কোনো সেনাসদস্য কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি বলেন জব্বার। শুধু প্রয়োজন না থাকলে বাইরে বের হতে নিষেধ করছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে বাইরে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইছেন।
ইউক্রেনে এখন শীত পড়তে শুরু করেছে কেবল। সকালের দিকে তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। তবে বরফ-ঝরা ইউক্রেনের জন্য তা কোনো শীতই না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই আবহাওয়া একটা মধুর আমেজ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে দিয়ে চলছিলও তাঁদের যুদ্ধকালের দিন।
কিন্তু তাতে ছেদ ঘটাল গতকালের হামলা। এরপর আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত কোনো হামলা হয়নি। আজ সকালে উঠেই কর্মস্থলে গেছেন আবদুল জব্বার। সেখান থেকে ভিডিও কলে স্কুলভবনটি দেখালেন, কিছু ছবিও পাঠালেন। কিয়েভের ঝকঝকে তকতকে প্রায় নির্জন রাস্তা, দুই দিকে সুদৃশ্য ভবন, নানা প্রজাতির গাছের সমাহার।
এই নির্জনতাকে খুন করে হয়তো আবার কিয়েভে হামলে পড়তে পারে পুতিনের ক্ষেপণাস্ত্র। কিয়েভবাসী বাংলাদেশিরা অবশ্য এখন আর তাতে ততটা ভীত নন। কিন্তু তাঁদের নিয়ে বেশি চিন্তিত দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনেরা।
হাসিনুল ও জব্বার বলেন, হামলার পর বাংলাদেশ থেকে ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজনের অসংখ্য ফোন পেয়েছেন। তাঁদের উৎকণ্ঠার জন্য মনে মনে কষ্ট পান তাঁরা।
জব্বার বলছিলেন, ‘ভয় এখন আর পাই না। কষ্ট লাগে আমাদের নিয়ে আত্মীয়দের উৎকণ্ঠা দেখলে। তাঁরা সত্যিই খুব ভয়ে থাকেন। তবে আমরা আশা করি, এমন কষ্ট বেশি দিন থাকবে না।’