ব্র্যাকের ‘প্লে বাস’ রঙে মাতানো শৈশব
‘আমি তো কহনো ভাবতেই পারি নাই এরুম দোলনায় চড়ব’ শিশু আরিফের কণ্ঠে খুশির ঢেউ। আরিফের বয়স আট বা নয়। ‘খালি বড়লোক গো পোলাপানগরে দেহি এমন সুন্দর দোলনায় চড়তে, টিভিতে যেরুম পোলাপানগো খেলতে দেহি এরুম খেলনায় অহন আমরাও খেলতে পারি।’ শিশু আরিফের হাতে কথা বলার আর সময় নেই। এখন শুধুই দিশাহারা হয়ে খেলবে। চঞ্চল হরিণের মতো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এক্কাদোক্কায় মেতে যায় সে। চার বছর বয়সের সাকিবের কাছে জানতে চাই, খেলার এই জায়গাতে কী করছে সে? ‘লং (রং) কলছি, ছুবি আঁকাইছি আল পুতুল বানাইছি।’ আরিফ ও সাকিবের বয়সী ছেলেমেয়েরা একজোট হয়ে খেলার প্রাঙ্গণ মাতিয়ে তুলছে।
প্রাঙ্গণটি কোনো খেলার মাঠ কিংবা রাজধানীর খোলামেলা এক টুকরা জায়গা নয়, যেখানে শিশুরা প্রাণভরে খেলতে পারবে, শৈশবটাকে রাঙাতে পারবে। এই খেলার জায়গাটি হলো একটি বাস। ভাবছেন বাসে খেলছে শিশুরা? এ আবার কেমন কথা? হ্যাঁ..., এটি ব্র্যাকের ‘প্লে বাস’। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক তাদের আইইডি প্রকল্পের আওতায় পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খেলার জন্য চালু করেছে এমন বাস। ব্র্যাক আইইডি এবং দা লেগো ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এটি একটি প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগ।
অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তানেরা তাদের অভিভাবকের সঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে খেলতে পারে। রংতুলিতে মেতে উঠতে পারে কিংবা খেলার জন্য বাবা-মায়েরা তাদের নানা রকম খেলনা কিনে দিয়ে থাকেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা সে সুযোগটা পায় না। কিন্তু তাদের শিশু মন খেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। তাদের খেলার কথা, মানসিক সুন্দর বিকাশের কথা ভাবনায় থাকে না কারও। কিন্তু তাদেরও খেলতে ইচ্ছা করে, রংতুলিতে আঁকতে ইচ্ছা করে হাজাররঙা প্রজাপতি। সেই ভাবনা থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়াতে, তাদের বিকাশের জন্য কাজ করছে ব্র্যাক আইইডি।
ব্র্যাক আইইডির ডিজাইন টিমের ব্যবস্থাপক এমারেন্ড উপমা এই আয়োজন সম্পর্কে বলেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা তাদের মৌলিক চাহিদাই ঠিকমতো পূরণ করতে পারে না। সেখানে তাদের খেলাধুলা কিংবা মানসিক বিকাশের বিষয়টি ভাবনার অনেক দূরে থাকে। কিন্তু পরবর্তী একটি নৈতিক মূল্যবোধের প্রজন্ম পেতে হলে আমাদের এই জায়গাটিতে কাজ করতে হবে। সেই ধাপে ব্র্যাক এই উদ্যোগটি নিয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েদের এমন উৎসাহ আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছে। তাদের মায়েরা আগ্রহভরে সন্তানদের এখানে দিয়ে যাচ্ছেন, যেন শিশুরা খেলতে পারে। আসলে এমন সুযোগ তো তাদের বাবা-মা দিতে পারেন না। যখন সুযোগটা দরজার কাছে এল, মায়েরা ভীষণ খুশি হয়ে উঠলেন। অনেক মায়ের আফসোস থাকত তাঁর সন্তান সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের মতো একটু যদি খেলতে পারত। ‘প্লে বাস’-এর কারণে অনেক মায়ের সেই আফসোস মিটে গেছে।’
সন্তান খেলার সুযোগ পাওয়ায় চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক ত্রিশোর্ধ্ব এক মায়ের। বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করা এই মা বলেন, ‘বাসাবাড়ির বাচ্চারা যহন নানা রকম খেলনা দিয়া খেলে, তহন আফসুস লাগত আমার মাইয়াডা যদি খেলতে পারত। এই বাসটা শখ পূরণ করল। আর এইহানে খেললে বাইচ্চা হারানির ডরও থাকে না।’
শিশুদের প্লে বাসে আনন্দের পরিবেশটি আরও আনন্দময় করে দিতে থাকেন খেলার সাথি। তাঁরা শিশুদের খেলতে, ছবি আঁকতে নানা ধরনের জিনিস তৈরিতে সহায়তা করেন। শিশুদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বেশ কয়েকজন খেলার সাথি থাকেন বাসে। খেলনা বানাতে যে খুব বেশি কিছু লাগে না, অল্প সামগ্রী দিয়ে মজার এবং সুন্দর সুন্দর খেলনা বানানো যায়, তা শিখিয়ে দেন শিশুদের। শিশুরা নিজেদের বানানো খেলনা দিয়েই নিজেরা খেলে।
শিশুদের এই খেলার সাথিরূপে বাসে অংশগ্রহণ করেন কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশু। বিভিন্ন রঙের মাস্ক তৈরি, কাগজের খেলনা বানিয়ে তাতে রং করে দেওয়াসহ নানা রকম গান-বাজনা করে আনন্দে মেতে ওঠেন তিনি।
মোর্শেদ মিশু বলেন, একজন শিশুর বিকাশ ঘটে আসলে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এই সময়টাতেই বঞ্চিত হয় অনেক কিছু থেকে।
শিশুদের নৈতিক শিক্ষা কিংবা তাদের মনের মধ্যে ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলার জন্য শৈশবে খেলাধুলা এবং এমন ইতিবাচক পরিবেশের বিকল্প নেই। ব্র্যাকের এই উদ্যোগ শিশুবান্ধব একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।