ঘূর্ণিঝড়ের পর দাবদাহ
আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত
আজ থেকে তাপমাত্রা কমে কয়েক দিন বৃষ্টি হতে পারে। তবে মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম থাকবে।
শক্তিশালী কোনো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর সাধারণত বড় অঞ্চলজুড়ে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা কমে আসে। যে দেশে আঘাত করে, সেই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের দেশগুলোতেও তাপমাত্রা কমে আসে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার সময় এবং আগে-পরে দেশে দাবদাহ অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতি আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
গত ২ এপ্রিল থেকে দেশে শুরু হওয়া দাবদাহের দাপট ঘূর্ণিঝড় মোখা খুব একটা কমাতে পারেনি। ঝড়টি আঘাত হানার সময় তো বটেই, গতকাল সোমবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবদাহ বয়ে গেছে। আজ মঙ্গলবার গরমের দাপট কিছুটা কমতে পারে। তবে দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় দাবদাহ অব্যাহত থাকবে।
বিশ্বের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, গত এপ্রিলের মতো চলতি মে মাসেও বাড়তি উত্তাপ থাকতে পারে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আশপাশের রাজ্য, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত এই দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসের বাকি সময়জুড়ে তা থেমে থেমে বয়ে যেতে পারে। ফলে গত এপ্রিলের মতো মে মাস সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসের উষ্ণ মাস হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও গবেষক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে টানা দাবদাহের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এবার ঘূর্ণিঝড়ের পরেও তা অব্যাহত থাকাটা আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে গত সোমবার একটি তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ও আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা নোয়ার ঘূর্ণিঝড় বিশেষজ্ঞ জেফ মাসটারস। তাতে তিনি ঘূর্ণিঝড়টিকে খুবই শক্তিশালী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি বাংলাদেশ উপকূলের কাছের বঙ্গোপসাগরে ঠান্ডা পানি ও শুষ্ক বাতাসের কারণে দুর্বল হয়ে যায়। তবে মিয়ানমারে এটি ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার গতি নিয়ে আঘাত করে। জাতিসংঘের স্যাটেলাইটের চিত্র বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়টির সঙ্গে আসা মেঘ বাংলাদেশের শুষ্ক বাতাসের কারণে বেশি বৃষ্টি ঝরাতে পারেনি। তবে মিয়ানমারে ভারী বৃষ্টি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বেশি বৃষ্টি না হওয়ার পেছনে চলমান দাবদাহের ভূমিকা দেখছেন আবহাওয়াবিষয়ক গবেষকেরা। তাঁদের ভাষ্যমতে, গত এপ্রিলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যে দাবদাহটি বয়ে যাচ্ছিল, তা সক্রিয় থাকায় ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কাছে এসে শক্তি হারায়। ঘূর্ণিঝড়টি মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করে যাওয়ার পরপর দেশটির রাখাইন রাজ্যসহ আশপাশের এলাকায় আবারও তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। অন্য দেশগুলোর অবস্থাও একই রকম।
আবহাওয়ায় আসছে ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি
যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া–এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবার তাপমাত্রা বেশি থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। নোয়াসহ আবহাওয়াবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, তিন বছর ধরে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় ‘লা নিনা’ পরিস্থিতি ছিল। লা নিনা সক্রিয় থাকলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কিন্তু চলতি বছর থেকে ওই অঞ্চলগুলোতে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে এল নিনো পরিস্থিতি (উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত) তৈরি হচ্ছে। এতে তাপমাত্রা বেশি থাকবে, বৃষ্টি কম হতে পারে। আবহাওয়া অস্বাভাবিক চরম আচরণ করতে পারে। এর কারণেই অতিরিক্ত উষ্ণতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকেরা।
এ বিষয়ে সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরজুড়ে এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সে কারণে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে এবার বেশি থাকছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের চলতি মাসের পূর্বাভাস বলছে, আজ থেকে তাপমাত্রা কমে কয়েক দিন বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে। তবে মে মাসের যে স্বাভাবিক গরম থাকার কথা, তার চেয়ে বেশি থাকতে পারে। মে মাসে সাধারণত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো হয়ে থাকে। সেখানে এবার এরই মধ্যে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গত এপ্রিল মাসেও দেশের গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, এবার এল নিনো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এ কারণে ঝড়–বৃষ্টি ও তাপপ্রবাহ—সবই অস্বাভাবিক আচরণ করছে।