অবরোধ ও ধর্মঘটে জনজীবন প্রায় স্থবির

বান্দরবানে অবরোধের তেমন প্রভাব পড়েনি। সকাল থেকে সেখানে যান চলাচল করেছে।

পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের জেরে তিন পার্বত্য জেলায় চলছে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ। এ পরিস্থিতিতে রাঙামাটিতে সতর্ক প্রহরায় বিজিবির সদস্যরা। গতকাল সকাল ১০টায় শহরের বনরূপা পেট্রলপাম্প চত্বরেছবি: সুপ্রিয় চাকমা

রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে নতুন করে কোনো সংঘাতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘটের প্রভাবে গতকাল শনিবার এই দুই জেলার জনজীবন ছিল অনেকটাই স্থবির।

এদিকে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি গেছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাঙামাটিতে বলেছেন, যারা আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে চাইছে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত শুক্রবার দুপুরে রাঙামাটিতে জারি করা ১৪৪ ধারা গতকালও বলবৎ ছিল। তবে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে শুক্রবার রাত ৯টার পর ১৪৪ ধারা জারির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।

বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে রাতে জেলা সদরে গোলাগুলিতে ৩ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন শুক্রবার রাঙামাটিতে আয়োজিত প্রতিবাদ মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হন।

  • রাঙামাটিতে ১৪৪ ধারা বলবৎ। খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারার মেয়াদ বাড়েনি।

  • সহিংসতার ঘটনা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করা হবে।

সহিংসতা–সংঘাতের প্রতিবাদে ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে গতকাল সকাল থেকে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে ‘সিএইচটি ব্লকেড’ নামে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার’ ব্যানারে ৭২ ঘণ্টার এ অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামের সংগঠন। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) অবরোধে সমর্থন দেয়।

এদিকে বাস, ট্রাক ও সিএনজি মালিক এবং শ্রমিক সমিতির ডাকে রাঙামাটিতে গতকাল সকাল ছয়টা থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। শুক্রবার রাঙামাটিতে বাস, ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এ ধর্মঘট ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন।

অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে রাঙামাটিতে কার্যত দূরপাল্লা ও স্বল্প দূরত্বের কোনো গাড়ি চলেনি। শহরের ভেতরেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ ছিল। দোকানপাট খোলেনি। কাপ্তাই হ্রদে নৌ চলাচলও ছিল সীমিত। এতে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে।

গতকাল সকাল থেকে খাগড়াছড়ির সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকার যান চলাচল বন্ধ ছিল। জেলায় বিভিন্ন উপজেলার মধ্যে চলাচলকারী জিপ বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলেনি। অবশ্য শহর এলাকায় কিছুসংখ্যক অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেখা গেছে। খাগড়াছড়ি বাজারের দোকানপাট খোলা থাকলেও পানছড়ি উপজেলার বাজার ও দীঘিনালা উপজেলা শহরে দোকানপাট খুলতে দেখা যায়নি।

বান্দরবানে অবরোধের তেমন প্রভাব পড়েনি। সকাল থেকে সেখানে যান চলাচল করেছে। শুধু বান্দরবান–রাঙামাটি সড়কে যান চলাচল সীমিত ছিল।

এদিকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘর্ষ ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পূর্বাপর তুলে ধরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) শুক্রবার দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউপিডিএফ প্রসঙ্গে যে কথা বলা হয়েছে, তাকে বানোয়াট ও প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপপ্রয়াস বলে দাবি করেছে আঞ্চলিক দলটি। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, দীঘিনালার বোয়ালখালীতে বাঙালিদের কথিত মিছিল চলাকালে ঘটনাস্থলে ইউপিডিএফের নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল না। খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় টহলরত সেনা দলের ওপর ইউপিডিএফ কর্মীদের গুলি ছোড়ার কথাও সত্যের অপলাপ।

‘সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে’

গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ তিনজন উপদেষ্টা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে গেছেন। এ সময় তাঁরা দুই জেলায় আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত বিশেষ বৈঠক করেন।

গতকাল বেলা তিনটার দিকে রাঙামাটিতে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির ঘটনায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এ সময় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় উপদেষ্টাদের পাশাপাশি পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম, চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়, সাবেক সংসদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার, জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন। সভায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, ব্যবসায়ী নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনো অবস্থায় অবনতি হতে দেওয়া যাবে না। আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাচ্ছি। যারা আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে চাচ্ছে, তাদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে যদি তারা আবার আইনশৃঙ্খলার অবনতির চেষ্টা করে, তাহলে তাদের হাত ভেঙে দেব।’

এ এফ হাসান আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমরা একটা বার্তা দিতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে থাকব।’

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হেলিকপ্টারে করে শহরের তবলছড়ি এলাকার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সেক্টর হেলিপ্যাড মাঠে উপদেষ্টারা পৌঁছান। বেলা একটার দিকে রাঙামাটি সেনা রিজিয়নের প্রান্তিক মিলনায়তনে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে উপদেষ্টারা খাগড়াছড়ি যান।

আহতদের অবস্থা স্থিতিশীল

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে আহত ২৪ জন দুই জেলার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের অবস্থা স্থিতিশীল বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল দুপুর পর্যন্ত রাঙামাটি সদর হাসপাতালে ১৯ জন ও খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে ৫ জন ভর্তি ছিলেন। বৃহস্পতিবার সংঘর্ষে আহত ১৫ জনকে খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৫ জন চিকিৎসাধীন।

খাগড়াছড়ি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, চিকিৎসাধীন পাঁচজনের অবস্থাই স্থিতিশীল। তাঁদের মধ্যে একজন বাঙালি, চারজন পাহাড়ি।

রাঙামাটি সদর হাসপাতালের আরএমও শওকত আকবর জানান, শুক্রবার ৩৮ জন ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯ জন এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। আহত ব্যক্তিরা ভালো আছেন। চিকিৎসাধীন ১২ জন পাহাড়ি।

এদিকে গতকাল দুই জেলার সদর হাসপাতাল থেকে নিহত চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল ত্রিপুরা (৩০)। রাঙামাটিতে নিহত ব্যক্তির নাম অনিক চাকমা (২৫)।