কোটা সংস্কারের সুপারিশ ছিল, বাস্তবায়ন নেই

পিএসসি একাধিকবার কোটা সংস্কারের সুপারিশ করেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন কমিটির প্রতিবেদনেও কোটাব্যবস্থা সহজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামের বটতলী রেলস্টেশন থেকে মিছিল নিয়ে টাইগারপাস এলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। পরে ২ নম্বর গেট এলাকায় পুলিশ তাঁদের ধাওয়া দেয়। গতকাল বিকেলে।জুয়েল শীল

সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময় সুপারিশ এসেছে। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) একাধিকবার কোটা সংস্কার বা সহজ করার সুপারিশ করেছিল। আবার বিভিন্ন কমিটির প্রতিবেদনেও এ ধরনের সুপারিশ ছিল; কিন্তু সব সময় সুপারিশগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। এখন সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড আছে। সরাসরি নিয়োগ হয় মূলত নবম থেকে ২০তম গ্রেডে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এসব চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। ওই বছর নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করা হয়। তবে ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে (মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) কোটা আগেও ছিল, এখনো আছে। যদিও প্রতিষ্ঠানভেদে এসব পদের কোটায় কিছু ভিন্নতা আছে।

এই রায়ের মূলকথা হলো, সব কোটা বজায় রাখতে হবে। তবে প্রয়োজনে বাড়ানো-কমানো যাবে। অবশ্য আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন। এর মানে হলো কোটার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবি ছিল কোটা সংস্কার করা; কিন্তু আন্দোলনের একপর্যায়ে পাঁচ গ্রেডের সব কোটা বাতিল করে দেয় সরকার। এবার আন্দোলনকারীরা সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে সময়ের বিবেচনায় সংস্কার করা উচিত।

নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগে কোটা বাতিল–সংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় প্রকাশিত হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। এই রায়ের মূলকথা হলো, সব কোটা বজায় রাখতে হবে। তবে প্রয়োজনে বাড়ানো-কমানো যাবে। অবশ্য আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন। এর মানে হলো কোটার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

চাকরিতে কোটার বিষয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি এখন আদালতের। তাই আদালতেই এর সমাধান হোক। এরপরও যদি আলোচনা করতে হয়, তা সব সময় করা যাবে।

জনপ্রশাসনমন্ত্রী গতকাল জানান, কোটাব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে। কিছু জেলাও বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি মনে করেন, সংবিধানের আলোকে সমতা দরকার।

পিএসসির তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরির ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো কোটায়। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ যোগ করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার পর কোটা বিবেচনা করার নিয়ম। একসময় কোটার অনেক পদ শূন্য থাকত। যদিও পরে নিয়ম চালু করা হয়—কোটায় পদ পাওয়া না গেলে তা মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।

সরকারি চাকরিতে কোটার প্রয়োগের বিষয়টি খুবই জটিল। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাওয়ারি পদ বণ্টনের নিয়ম রয়েছে। ফলে প্রার্থী নির্বাচন ও পদ বণ্টনে সমস্যা হতো। এ জন্য পিএসসিসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল।

কোটার বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে তিনি মনে করেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংস্কার করা উচিত।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া

পিএসসির ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কোটাসংক্রান্ত নীতিমালার প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কোটাপদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব। প্রার্থীদের বিভিন্ন ক্যাডারের চাকরির পছন্দক্রম এবং কোটার সঙ্গে বিভিন্ন জেলা বা বিভাগের জন্য আরোপিত সংখ্যাগত সীমারেখা সংযুক্ত হয়ে এমন একটি বহুমাত্রিক সমীকরণ কাঠামোর সৃষ্টি করেছে, যার নির্ভুল সমাধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মানবীয়ভাবে প্রায় অসম্ভব। এ জন্য পিএসসি বলেছিল, কম সময়ে ও সুচারু এবং নির্ভুলভাবে বিসিএস পরীক্ষাসহ নন-ক্যাডারে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা প্রয়োগপদ্ধতি সহজ করা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় কোটা প্রয়োগসংশ্লিষ্ট জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

কোটা প্রয়োগপদ্ধতির ওপর বিস্তারিত পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ শেষে কোটা প্রয়োগপদ্ধতি সহজ করার বিষয়ে ২০০৯ সালের ১৯ মার্চ সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করেছিল পিএসসি। ওই সুপারিশের মধ্যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার কোটাগুলো জাতীয় পর্যায়ে বণ্টন করা যেতে পারে। অর্থাৎ ওই কোটাগুলোকে পুনরায় জেলা বা বিভাগভিত্তিক ভাগ করা যাবে না বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্য পদের সর্বোচ্চ সংখ্যা দিয়ে সীমিত করা যাবে না। এ ধরনের কোটার পদগুলো জাতীয়ভিত্তিক নিজস্ব মেধাক্রম অনুযায়ী ওই কোটায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে। ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও পিএসসি এ ধরনের সুপারিশ করেছিল।

জনপ্রশাসনমন্ত্রী গতকাল জানান, কোটাব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে। কিছু জেলাও বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি মনে করেন, সংবিধানের আলোকে সমতা দরকার।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের সময়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে একটি কমিটি করেছিল সরকার। ওই কমিটি তিনটি সুপারিশ করে। প্রথম সুপারিশটি ছিল নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া। দ্বিতীয় সুপারিশটি ছিল এসব গ্রেডে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা এবং তৃতীয় সুপারিশটি ছিল কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময়ে পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। অর্থাৎ প্রথম দুটি সুপারিশের মূলকথা হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোটা থাকবে না। এসব পদে নিয়োগ হবে সরাসরি মেধার ভিত্তিতে।

ওই কমিটির তৃতীয় সুপারিশটির ব্যাখ্যা হলো, সময়ের প্রেক্ষাপটে যদি কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় যে কোটা অপরিহার্য, তবে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে। বিষয়টি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সে অনুযায়ী সরকার চাইলে কোটা সংস্কার করতে পারে।

এর আগে ২০০৮ সালে প্রয়াত মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান ও সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে কোটাব্যবস্থার ওপর গবেষণা করে তা কমানোর সুপারিশ করেছিলেন। ওই গবেষণায় বলা হয়, অগ্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি হতে পারে না। পিএসসির উদ্যোগে এই গবেষণা হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। আকবর আলি খান একবার বলেছিলেন, ২৫৮ ধরনের কোটা আছে। চাকরিতে এই কোটাব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার করা উচিত।

চাকরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন কোটার বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে তিনি মনে করেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংস্কার করা উচিত।