জন্মনিবন্ধন সনদে জন্মসাল সংশোধনে ভোগান্তি বেশি
জন্মের দিন ও মাস সংশোধনে ডিসি এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের কাছে আবেদন করতে হয়। তবে বছর সংশোধনে যেতে হয় ঢাকায়
লুৎফর রহমান ঢাকার একটি সরকারি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও সব শিক্ষাসনদে তাঁর জন্মতারিখ ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি। তবে জন্মনিবন্ধন সনদে এ তারিখ লেখা ১৯৯৮ সালের ১৬ মার্চ। সম্প্রতি বিদেশে শিক্ষার্থী ভিসার আবেদনের প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনে থাকা বয়স সংশোধনের প্রয়োজন হয় তাঁর।
তবে লুৎফর রহমান চার মাস ধরে নিজ এলাকা শরীয়তপুর ও ঢাকা ঘুরে এ সমস্যার কোনো সুরাহা করতে পারছেন না। এরই মধ্যে ১ অক্টোবর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে তাঁর জন্মসনদ সংশোধন করা যাবে না বলে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
যাচাই–বাছাইয়ে যদি বোঝা যায়, ম্যানুয়াল থেকে অনলাইনে তোলার সময় জন্মসাল ভুল তোলা হয়েছে, তবে তা সংশোধন করে দেওয়া হয়। তবে অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে জন্মসাল পরিবর্তন করছেন। সেসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
লুৎফর রহমানসহ কয়েকজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে, যাঁরা জন্মসনদে বয়স সংশোধনের জন্য ঘুরছেন। ‘সার্ভার ডাউন’ সমস্যায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধন নিয়ে এখন সমালোচনার মুখে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। বিশেষ করে জুলাই মাসে লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁসের ঘটনার পর সার্ভার ডাউনের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে।
জন্মসাল পরিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়ার কথা শুনে অন্তত দুজন অভিভাবককে সিদ্ধান্ত বদল করতে দেখা গেছে। তাঁরা তাঁদের শিশুসন্তানের জন্মসাল পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
সামনে শিশুদের স্কুলে ভর্তি এবং অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল স্কুল থেকে বোর্ডে পাঠানোর প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধনের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আবেদন করতে পারছেন না অনেক অভিভাবক। এক অভিভাবক জানান, মেয়ের পাসপোর্টের প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনের ভুল সংশোধনে তিনি বাসায় কম্পিউটারে আবেদন করতে ব্যর্থ হন। পরে দোকানে গিয়ে আবেদন করতে ব্যর্থ হন। কেন্দ্রীয়ভাবে সার্ভার ডাউনের সমস্যার কথা জানিয়ে দোকানের কর্মীরাও তাঁকে ফেরত পাঠান। এখন তিনি কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না।
নামের বানানসহ ছোটখাটো সমস্যা ইউনিয়ন পরিষদ ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে সংশোধন করা যায়। জন্মের দিন ও মাসের ভুল সংশোধন করতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের (ডিডিএলজি) কাছে আবেদন করতে হয়। আর জন্মের বছর সংশোধনের ক্ষেত্রে ঢাকায় অবস্থিত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সিদ্ধান্তই সব।
অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে জন্মসাল পরিবর্তন করছেন। সেসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের কয়েকজন যা বললেন
ভুক্তভোগীদের একজন শিক্ষার্থী লুৎফর রহমান (ওপরে উল্লিখিত) বলেন, তাঁর জন্মনিবন্ধন যখন করা হয়েছিল, তখন দোকান থেকে ইচ্ছেমতো একটি বয়স বসিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ১৯৯৮ সাল লেখা ছিল। পরে তিনি বিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশনের সময় ভিন্ন জন্মসাল উল্লেখ করেন। তাঁর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সনদে এই সালটি লেখা। জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করা হয়েছে শিক্ষাসনদের সাল অনুযায়ী। এখন ভিসার জন্য অনলাইনভুক্ত জন্মনিবন্ধন প্রয়োজন হলে তিনি জন্মসাল সংশোধনের আবেদন করেন তাঁর এলাকায় শরীয়তপুরে। সেখান থেকে তাঁকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। চার মাস ধরে তিনি ঘুরছেন। এখন তাঁকে বলা হয়েছে, জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষাসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের বছর সংশোধন করে নিতে। হতাশ কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এটা কি সম্ভব?’
ঢাকায় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে বোনকে নিয়ে আসা এক ভাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁকেও একই (লুৎফরের মতো) পরামর্শ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
খুলনা থেকে আসা শওকত আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ২০১০ সালে তিনি তাঁর এক মেয়ের জন্মনিবন্ধন করেন। জন্মসাল উল্লেখ ছিল ২০০২। পরে ২০২০ সালে তাঁর জন্মসনদ অনলাইনভুক্ত হয়। যাঁরা অনলাইনভুক্ত করেছিলেন, তাঁরা দিন ও মাস ঠিক রাখলেও জন্মবছর ২০০০ সাল লেখেন। অথচ ওটা তাঁর বড় মেয়ের জন্মসাল। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় তাঁর আবেদন গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, এ কাজের জন্য তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় একাধিকবার ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে।
জন্মসাল পরিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়ার কথা শুনে অন্তত দুজন অভিভাবককে সিদ্ধান্ত বদল করতে দেখা গেছে। তাঁরা তাঁদের শিশুসন্তানের জন্মসাল পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে দেখা হয় ২ অক্টোবর মিরপুর-১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে। তিনি জন্মসাল সংশোধনের জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে যাওয়ার কথা শুনে সিদ্ধান্ত বদলান বলে জানান। অপর অভিভাবকের সঙ্গে দেখা হয়, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে। তিনি পুরো প্রক্রিয়ার কথা শুনে বলেন, ‘থাক দরকার নেই বয়স পাল্টানোর।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম বলেন, ‘বয়স পরিবর্তনজনিত সংশোধন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ করে। তবে অনলাইনে আবেদনটি স্থানীয়ভাবে হলে ভোগান্তি কম হবে।’
নির্দেশনায় যা আছে
গত ৬ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, আইন-বিধিতে শিশুর জন্মের পরপর এবং ব্যক্তির মৃত্যুর পরপর এ-সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধককে দেওয়া ও নিবন্ধনের তাগিদ রয়েছে। শিশুর ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদে লিখিত তারিখই তার প্রথম ও আদি জন্মতারিখ। এ তারিখের ভিত্তিতেই তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়ে থাকে।
কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই পাবলিক পরীক্ষায় নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি, পাসপোর্ট করার সময় জন্মনিবন্ধন সনদে উল্লেখ করা জন্মতারিখের পরিবর্তে অন্য একটি তারিখ বসানো হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কাজে জন্মসনদেরও প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, বিশেষ করে জন্মসনদে উল্লেখ করা সাল সংশোধনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন। নিবন্ধক কার্যালয় এসব আবেদন গ্রহণ, আপলোড ও অনুমোদনের জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠায়। এটা সমীচীন নয়।
জন্মসাল পরিবর্তনের জন্য আসা ব্যক্তিদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরলে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই–বাছাইয়ে যদি বোঝা যায়, ম্যানুয়াল থেকে অনলাইনে তোলার সময় জন্মসাল ভুল তোলা হয়েছে, তবে তা সংশোধন করে দেওয়া হয়। তবে অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে জন্মসাল পরিবর্তন করছেন। সেসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।