নতুন ভাড়ার হার বিশ্লেষণ: বাসে ৩৩ কিলোমিটার গেলে ব্যয় কমবে ১ টাকা
জ্বালানি তেল ডিজেলের দাম কমানোর পর বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ৩ পয়সা কমাল সরকার। নতুন ভাড়া অনুযায়ী একজন যাত্রী ৩৩ কিলোমিটার ভ্রমণ করলে তাঁর এক টাকা সাশ্রয় হবে।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন যাত্রী অধিকার নিয়ে সচেতন ব্যক্তিরা।
এর আগে ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া পাঁচ পয়সা কমানো হয়েছিল। কিন্তু তা মানেননি পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা। অথচ এর এক মাস আগে ৬ আগস্ট ভাড়া ৪০ পয়সা বাড়ানো হয়েছিল। তবে সেই হার ঘোষণার আগেই পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন।
২০১৬ সালে ৩ পয়সা এবং ২০১১ সালেও ২ পয়সা বাসভাড়া কমানো হয়েছিল। পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ওই ভাড়া মানেননি।
পরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভাড়া কমানোর সরকারি এই উদ্যোগ লোকদেখানো। এটা বাস্তবায়িত হওয়ার আশা কম। ভাড়া বৃদ্ধির সময় পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো হারে আদায় করেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও জরিমানা করে। তারপর বাড়তি ভাড়া আদায় চলতে থাকে।
ভাড়া সামান্য কমানো হলে সেটা বাস্তবায়নে উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এবারও নতুন ভাড়া কার্যকর করার বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের আশা কম।
স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালুর পর গত মাস মার্চের ক্ষেত্রে ডিজেলের দাম লিটারে ৭৫ পয়সা কমেছিল। এপ্রিলের ক্ষেত্রে গতকাল সোমবার থেকে ডিজেলের দাম লিটারে ২ টাকা ২৫ পয়সা কমানো হয়েছে। সব মিলিয়ে লিটারে ডিজেলের দাম কমল ৩ টাকা। এখন প্রতি লিটার ডিজেল ১০৬ টাকা।
জ্বালানির মূল্য কমানোর পর সোমবার বিআরটিএর বাসভাড়া নির্ধারণ কমিটি বৈঠক করে বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৩ পয়সা কমানোর সুপারিশ করে।
জ্বালানির মূল্য কমানোর পর সোমবার বিআরটিএর বাসভাড়া নির্ধারণ কমিটি বৈঠক করে বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৩ পয়সা কমানোর সুপারিশ করে। সন্ধ্যায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করেছে। মঙ্গলবার থেকে নতুন ভাড়া হার কার্যকর হবে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরই নতুন ভাড়া কার্যকর হয়।
তবে বিআরটিএ ভাড়া তালিকা সমন্বয় করতে আরও কয়েক দিন সময় নেবে বলে জানা গেছে।
মার্চে এসে জ্বালানির দাম সামান্য কমানো হলেও এর আগে তা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছিল। প্রতিবারই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতারা ভাড়া বাড়ানোর দাবি তোলেন। ভাড়া নির্ধারণের সময় তাঁরা জ্বালানির মূল্য ছাড়াও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি যুক্ত করার জন্য চাপ দেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, জ্বালানির দামের কারণে ভাড়া যতটা বাড়ার কথা, তার চেয়ে বেশি বাড়ে।
এর আগে ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া পাঁচ পয়সা কমানো হয়েছিল। কিন্তু তা মানেননি পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা।
নতুন ভাড়া হার
মঙ্গলবার থেকে আন্তজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া হবে ২ টাকা ১২ পয়সা। এত দিন তা ছিল ২ টাকা ১৫ পয়সা।
দূরপাল্লার পথে অনেক পরিবহন কোম্পানি আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য বাসের আসন কমিয়ে চালায়। এসব বাসের ভাড়া আনুপাতিকভাবে পুনর্নির্ধারিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রুট পারমিট অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি আনুপাতিকভাবে ভাড়ার হার অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪২ পয়সা।
পরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভাড়া কমানোর সরকারি এই উদ্যোগ লোকদেখানো। এটা বাস্তবায়িত হওয়ার আশা কম।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী মিনিবাস এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ১০ টাকা এবং ৮ টাকা আগের মতো বহাল রাখা হয়েছে।
নতুন ভাড়ার হার গ্যাসচালিত বাস–মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলে উল্লেখ করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
২০২২ সালে বাসের ভাড়া বৃদ্ধির সময় বলা হয়েছিল, সিএনজি গ্যাসচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া কার্যকর হবে না। তখন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করে, এখন আর গ্যাসচালিত বাস খুব একটা চলে না। বাসগুলোর সামনে ডিজেলচালিত লিখে চলাচল শুরু করে। এখন ভাড়া কমানোর ঘোষণায় সব বাস কম ভাড়া নেয় কি না, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
বাসভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত যাত্রীদের সঙ্গে তামাশা। কারণ, এর আগেও সামান্য ভাড়া কমানোর কোনো প্রভাব পড়েনি।মোজাম্মেল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব
মহানগরে ভাড়া কমানোর প্রভাব কতটা
রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় ৩০০ রুটে বাস চলাচলের অনুমোদন আছে। এতে চলাচলের অনুমতি নেওয়া আছে ৭ হাজারের মতো বাস-মিনিবাসের। অধিকাংশ রুটের গন্তব্যের শুরু এবং শেষ ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রুটগুলোও একই। এ ছাড়া নগরের যাত্রীদের বড় অংশই স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করেন। ফলে এই দুই মহানগরের যাত্রীরা ভাড়া কমানোর সুফল কতটা পাবেন, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
মিরপুর পল্লবী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাস চলাচল করে। বিআরটিএর হিসাব অনুসারে, পল্লবী থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। সে হিসাবে একজন যাত্রী পুরো পথ ভ্রমণ করলে ৫০ পয়সা ভাড়া কমবে।
মিরপুরের দোয়ারীপাড়া বা মিরপুর থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত বহু কোম্পানির মিনিবাস ও বাস চলাচল করে। এই পথের দূরত্ব ১৫-১৬ কিলোমিটারের মধ্যে। ফলে এখানে যাত্রীদের ভাড়া কমানোর সুফল পাওয়ার সুযোগ কম। পল্লবী থেকে গুলিস্তান কিংবা মতিঝিলের দূরত্ব যথাক্রমে ১৬ ও ১৭ কিলোমিটার। এই পথের যাত্রীরা সুফল পাবেন না।
২০১৬ সালে ৩ পয়সা এবং ২০১১ সালেও ২ পয়সা বাসভাড়া কমানো হয়েছিল। পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ওই ভাড়া মানেননি।
সাভারের বাইপাইল, ইপিজেড, চন্দ্রা থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে বেশ কিছু কোম্পানির বাস চলাচল করে। এগুলোর গন্তব্য ঢাকার কেরানীগঞ্জ, খিলগাঁও, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে। এই পথগুলোর দূরত্ব ৩৫ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। এসব পথে যাত্রীরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাতায়াত করলে এক থেকে দেড় টাকা কম ভাড়া দেওয়ার সুযোগ আছে।
তবে এসব পথের বাসের বেশির ভাগই গেটলক কিংবা নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ভাড়া হার নিজেরা ঠিক করে নিয়েছে। ফলে আগে থেকেই তারা বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
ভাড়া সামান্য কমানো হলে সেটা বাস্তবায়নে উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এবারও নতুন ভাড়া কার্যকর করার বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের আশা কম।
দূরপাল্লার পথেও প্রভাব কম
দূরপাল্লার পথে এসি বাসে সরকার কোনো ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় না। ফলে জ্বালানির মূল্য কমার কারণে ভাড়া কমানোর দায়বদ্ধতা নেই তাদের। এই বাসগুলোর মালিকদের ইচ্ছার ওপর যাত্রীদের ভাড়া নির্ভর করে।
এর বাইরে দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী বাসগুলো ২৭ থেকে শুরু করে ৫২ পর্যন্ত আসন রয়েছে। সরকার শুধু ৪০ ও ৫২ আসনের ভাড়া অনুমোদন করে। বাকি বাসগুলোর আসন কত হলে ভাড়া কত হবে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। আর ভাড়ার তালিকা বাসে বা কাউন্টারে টানানোর নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। এই পথের বাসের একটা বড় অংশই এসি। ফলে এগুলোতে ভাড়া কমানোর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। নন-এসি ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া কমবে ৭ টাকা ২৬ পয়সা। অথচ এবার ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী এই শ্রেণির বাসের বেশির ভাগেই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৫৭ কিলোমিটার। এই পথে পৌনে ৮ টাকা ভাড়া কমবে। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলাগুলো ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফলে এসব জেলার যাত্রীদেরও সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সড়কপথে ঢাকা থেকে সবচেয়ে বেশি দূরের যাত্রা হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ—৪৬২ কিলোমিটার। এই পথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ যাতায়াত করলে প্রায় ১৪ টাকা কম ভাড়া দিতে পারবেন। এরপর পঞ্চগড়ের দূরত্ব ৪২৪ কিলোমিটার। এই পথের যাত্রীদের ১২ টাকা ৭২ পয়সা কম ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগ আছে। কক্সবাজারের দূরত্ব ৩৯৬ কিলোমিটার এবং ভাড়া কমবে প্রায় ১২ টাকা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত যাত্রীদের সঙ্গে তামাশা। কারণ, এর আগেও সামান্য ভাড়া কমানোর কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি বলেন, ডিজেলের বড় ভোক্তা পরিবহন খাত। মূল্যবৃদ্ধি বা কমানোর প্রভাব যাত্রীদের মধ্যে পড়ে। তাই ডিজেলের মূল্য অল্প না কমিয়ে বেশি কমানো উচিত।
মোজাম্মেল হক, বাসভাড়াও বেশি হারে কমিয়ে তা কার্যকর করার জন্য কঠোর হতে হবে। অমান্যকারীদের শাস্তি-জরিমানার আওতায় আনতে হবে।