বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়ের সংখ্যা বেশি। শুধু ঢাকা শহরেই পাঁচ শতাধিক এ ধরনের ছোট পতঙ্গ ও প্রাণী বাস করে। তবে এগুলোর সবই যে আমাদের জন্য ক্ষতিকর, তা নয়। কিছু উপকারী পোকা ও প্রাণী আমাদের ঘরে এবং চারপাশে বিচরণ করতে দেখি। মশার পরে মূলত ঘরে এসে উৎপাত করা তেলাপোকা, উইপোকা, ছারপোকা নিয়ে শহরবাসীর বেশি দুশ্চিন্তা। কারণ, এগুলো বিড়ম্বনার পাশাপাশি নানা রোগবালাই ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
আমাদের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ বড় শহরগুলো শুধু মশা মারার কাজটি করে থাকে। এর কারণও আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে মশা বাহক হিসেবে কাজ করে। অন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও দমনে তাদের কোনো তৎপরতা নেই।
তাই নগরবাসী নিজ দায়িত্বে ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব কীটপতঙ্গ দমনের কাজটি করে থাকে। এ পরিস্থিতির কুফল কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তার বড় প্রমাণ আমরা সম্প্রতি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা থেকে টের পেলাম। এ ঘটনার পর আশা করি, আমাদের বিষয়টি নিয়ে হুঁশ ফিরবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে বাসাবাড়িতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশকের একটি বিধিবদ্ধ তালিকা আছে। ইচ্ছা করলেই কোনো কীটনাশক যেখানে-সেখানে ব্যবহার করা যায় না। কীটনাশক ব্যবহারে নীতিমালা ও আইন রয়েছে। কোন ধরনের কীটনাশক জনস্বার্থে ব্যবহার করা যাবে, তার একটি তালিকার অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ধারণা করি, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের সেবাদানকারী কোম্পানি নিশ্চয়ই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা না মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করেছে।
পুলিশ বলছে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ওই বাসায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড নামের বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছিল।
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড একধরনের কীটনাশকের জেনেরিক নাম। এটি মারাত্মক বিষাক্ত কীটনাশক, যা আমাদের দেশে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। ছারপোকা দমনে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে এই ট্যাবলেট। বাংলাদেশের বাজারে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা, ধানখেতের পোকা, কলাগাছের গুঁর পোকা ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ট্যাবলেট থেকে ফসফিন নামের গ্যাস নির্গত হয়, যা বদ্ধ ঘরকে বিষাক্ত করে তেলাপোকা ও ছারপোকা মেরে ফেলে। ফসফিন গ্যাস মানুষের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত।
কীটনাশকের বিষক্রিয়া মানুষের শরীরে কোষে কোষে পৌঁছে যায়। এতে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রতঙ্গ যেমন কিডনি, পাকস্থলী ও মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ে, খিঁচুনি হয়, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ঘরে যেকোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের আগে অবশ্যই কোনো অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ লোক দিয়ে কীটনাশক প্রয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রতিটি কীটনাশকের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা এবং ব্যবহারের কিছু নিয়ম আছে। নিয়ম মেনে কীটনাশক ব্যবহার না করলে সেটি ভয়ংকর ফল বয়ে আনতে পারে।
দক্ষতার সঙ্গে ওষুধ দেওয়া, এর মাত্রা সম্পর্কে জানা, কোন ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, কী পরিমাণে দেওয়া হচ্ছে, প্রভাব কতক্ষণ থাকবে এবং এরপর কীভাবে বাড়ি পরিষ্কার করা হবে—এসব তথ্য নিশ্চিত হয়ে পরিবারের অন্তত একজনকে ভালোভাবে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বুঝিয়ে সবাইকে অবগত করা গুরুত্বপূর্ণ। এটা ‘বিষাক্ত কীটনাশক’ বলে এর ক্ষতিকর দিক থাকবেই। তাই কতটা কম ক্ষতি হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা নির্দেশনাবিষয়ক পত্র গৃহকর্তার স্বাক্ষর নিয়ে তাঁকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। সাধারণ মানুষ যাঁরা কীটনাশক ব্যবহার করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদেরও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।
আমাদের দেশে কীটপতঙ্গ দমন এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশকের ব্যবহারের বিষয়টি মূলত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি আলাদা বিভাগের। তারা কৃষি ছাড়া অন্য কোনো খাতে, মানে শহরের কীটনাশকের ব্যাপারে কোনো তদারকি করে না। ফলে শহরে অনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে কীটনাশকের ব্যবহার আমরা বাড়তে দেখছি। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ বড় শহরের সিটি করপোরেশনের আওতায় কীটপতঙ্গ দমনবিষয়ক আলাদা কর্তৃপক্ষ আছে।
আমাদের এখানেও এ ধরনের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার, যারা মশার মতো অন্যান্য কীটপতঙ্গ দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করবে। নাগরিকদের সচেতন করবে। আর কীটনাশকের ব্যবহারের বিষয়টিও তারা দেখভাল করবে। নয়তো কীটনাশকের এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে ক্ষতি বাড়তে থাকবে।
কবিরুল বাশার, অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়